ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

খুলনার গ্রামেও মিলছে না খেজুর রস!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২০
খুলনার গ্রামেও মিলছে না খেজুর রস! খেজুরগাছে হাড়ি বাঁধা। ছবি: বাংলানিউজ

খুলনা: কুয়াশার আস্তরণ কেটে সকালের সূর্য চোখ মেলছে। তবে উত্তরে হাওয়ায় যে কনকনে শীত, তা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছে। ঋতুবৈচিত্র্যের পালাক্রমে চলছে শীত। শীতকালীন খাদ্য তালিকায় প্রথমেই আসে মুখরোচক খেজুরের রস। কিন্তু গাছির অভাবে সেই মুখরোচক খেজুর রস এখন বিলুপ্তির পথে। রস না পাওয়ার জন্য গাছির অভাব ও ইটভাটার আগ্রসনকে দায়ী করছেন অনেকে।

কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালটা কোনো এক সময় যেন খেজুরের রস ছাড়া জমতোই না। শীত ও খেজুরের রস যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলো।

শীত যত বাড়তো খেজুরের রসের চাহিদাও ততো বাড়তো। গ্রামীণ জনপদের ঘরে ঘরে এই রস দিয়ে তৈরি হতো নানা ধরনের পিঠাপুলি। বিশেষ করে খুলনার রূপসা, বটিয়াঘাটা, দাকোপ, ডুমুরিয়া, পাইকগাছা, ফুলতলা, তেরখাদা, দিঘলিয়া উপজেলায়। কিন্তু এখন বদলে গেছে সে চিত্র। গ্রামেও মিলছে না খেজুর রস। খেজুরগাছে হাড়ি বাঁধা।  ছবি: বাংলানিউজরূপসার আঠারো বেকী মডেল বিদ্যাপীঠের প্রধানশিক্ষক শাখাওয়াত হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য খেজুর রস সংগ্রহে শীতকালে প্রতিটি গ্রামে গ্রামে গাছিরা খেজুরগাছ কাটার কাজে ব্যস্ত সময় পার করতেন। আমার ১৮টি খেজুরগাছ আছে। কিন্তু গাছি না পাওয়ায় এবার কাটা হয়নি। আগে যেখানে আমাদের গ্রামে ৩০০ থেকে ৪০০ গাছ কাটতো গাছিরা এখন সেটা ৩০ থেকে ৪০ এ নেমে এসেছে। আগে এক হাড়ি রসের দাম ৪০ থেকে ৬০ টাকা নিতো। এখন এক হাড়ি রসের দাম ২০০ থেকে ২২০ টাকা। আমার অবাক লাগে কীভাবে বাজারে খেজুরের গুড় পাওয়া যায় ১৪০ থেকে ১৮০ টাকায়। হাড়ির গায়ে রসের মূল্য । রূপসার মৈহিশাঘূনী গ্রামের গাছি রনি শেখ বাংলানিউজকে বলেন, শীতকালে সকাল-সন্ধ্যা গ্রামীণ পরিবেশটা খেজুর রসে মধুর হয়ে উঠতো। রস আহরণকারী গাছিদের প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত সে সময়ে। রস জ্বালিয়ে পাতলা ঝোলা, দানাগুড় ও পাটালি তৈরি করতেন অনেকে। এখন আগের মতো গাছ ও নেই। গাছ কেটে ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যা কিছু গাছ আছে তাতে আগের মতো রস হয় না।

দাকোপের আচাভূয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব গোলাম মোস্তফা খান বলেন, আমাদের এলাকায় গাছ কেটে রস বের করার কোনো গাছি পাওয়া যাচ্ছে না। যদিও বা কারো কারো গাছ রয়েছে, কিন্তু কেটে রস বের করার লোক নেই। কিশান (কৃষক) খরচ করে এ কাজে বিশাল লোকসান তাই খেজুরগাছ কাটা বন্ধ হয়ে গেছে। বছরের পর বছর খেজুরগাছ না তোলায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। যদিও কেউ কিশান দিয়ে তোলায় তবে, পরে আর কেটে রস বের করার কোনো গাছি না থাকায় বিলুপ্তির পথে খেজুর রস। বাজারে যে খেজুর গুড় পাওয়া যায় সব ভেজাল, বিষ বলা যায়। ..খুলনায় বসবাসকারী মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের উপ-সহকারী প্রকৌশলী (নৌ) মো. নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কদর বেড়ে যেতো খেজুর গাছের। গাছ থেকে রস সংগ্রহ, গুড় তৈরি; আর রস ও গুড়ের নানা শীতকালীন পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত আবহমান গ্রাম বাংলায়। সারাবছর অবহেলিত খেজুর গাছগুলোকে ঝুড়ে নতুন রূপ দিতেন গাছিরা। সেই রস অনেক গাছি বেশি দাম পাওয়ার আশায় শহরে নিয়ে আসতেন। শীতের সকালে সূর্যি মামা উঁকি দেওয়ার আগেই গাছিরা গাছ থেকে রসের হাড়ি নামিয়ে দূর-দূরান্তের হাট-বাজারেও নিয়ে যেতেন। রস কিনতে অনেক লোকের সমাগম দেখা যেত রসের হাঁটে। কিন্তু শহরে এখন আর রস পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তার দাম আকাশচুম্বী। এছাড়া ভেজালের ভয় তো রয়েছেই।

লবনচরা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক অর্ক আহসান তুরান বলেন, শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো কাচা রসের স্বাদ যেমন বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তেমনি জ্বাল করা রসের তৈরি বিভিন্ন খাবারের স্বাদও অতুলনীয়। খেজুরের রসের সাধ ও ঘ্রাণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। নতুন প্রজন্মের কাছে এর স্বাদ রূপকথা মনে হলেও সেটাই বাস্তব।

রূপসা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. ফরিদুজ্জান বলেন, আগে রূপসার সব গ্রামেই কম বেশি খেজুরগাছ ছিলো। এখন আচতগাতি ও শ্রীফলতলা গ্রামে কিছু খেজুরগাছ আছে। যে গাছ থেকে গাছিরা রসও সংগ্রহ করছেন। গত কয়েক বছরে এ উপজেলা থেকে অনেক খেজুরের গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। খেজুরগাছ থাকলেও গাছির অভাবে মিলছে না রসের দেখা। গাছির অভাব, ইটভাটার আগ্রসন ও নগরায়ণের ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গাছিরা। যারা আছেন তারা রস ও গুড় বিক্রি করে তাদের সংসার চালাতে পারছেন না।

তিনি আরও বলেন, বজ্রপাত থেকে সুরক্ষা পেতে সারাদেশে তাল ও খেজুরগাছ রোপনের কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় রূপসা উপজেলায় তাল ও খেজুরগাছ রোপন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪ , ২০২০
এমআরএম/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।