ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সেই রেডিওটি এখন আর বাজে না...

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
সেই রেডিওটি এখন আর বাজে না...

ঈশ্বরদী, পাবনা: ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশন (বিবিসি) বিশ্বের অতি জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যম। কিন্তু এ জনপ্রিয় সংবাদ মাধ্যমের নামে বাংলাদেশে একটি বাজার রয়েছে যা হয়তো অনেকেরই অজানা। বাজারটির নাম ‘বিবিসি বাজার’। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এক গৌরবময় স্মৃতিধারণ করে গড়ে ওঠে এ বাজারটি।

১৯৭১ সাল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্যাম্প বসিয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি ইউনিয়নের পেপার মিল ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ এলাকায়।

পেপার মিল থেকে দক্ষিণ দিকে সামান্য পথ গেলেই গ্রামটি। ওই গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন কাশেম মোল্লা। অভাবের কারণে ক্লাস সেভেনের বেশি পড়েননি তিনি। জীবনযুদ্ধে টিকে থাকতে পাকশী রেল বাজারে দেন একটি মুদি দোকান।  

’৭১-এর ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানি হানাদাররা বাজার পুড়িয়ে দিলে, তিনি চলে যান নিজ গ্রাম পাকশীর রূপপুরে। নিজের হাতে লাগান একটি কড়ই গাছ। গাছের পাশেই দেন ছোট্ট একটি চায়ের দোকান। তখন স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের ইচ্ছায় কাশেম মোল্লা ‘থ্রি ব্র্যান্ড’র একটি রেডিও কেনেন। তখন পাঁচ গ্রামে খুঁজেও একটি রেডিও পাওয়া যেত না। সেই সময় ‘থ্রি ব্র্যান্ড’ রেডিওর মালিক হওয়া ছিল রীতিমত গর্বের ব্যাপার। চায়ের দোকানে ক্রেতাদের ভিড় জমানোর জন্য রেডিওটি তিনি প্রতিদিন দোকানে নিয়ে যেতেন। দেশে যুদ্ধ লাগার পর দেশের সামগ্রিক অবস্থান নিয়ে বিবিসি বাংলায় খবর প্রচারিত হতো।  

খবর শোনার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তার চায়ের দোকানে অবস্থান নিতেন। রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও কলকাতা বেতারের খবর শোনার জন্য আশপাশের মানুষ দু’বেলা নিয়মিত ভিড় জমাতো তার চায়ের দোকানে। খবরে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের খবর শুনে অনেকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। পাকহানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি রেডিওতে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর শোনাতেন। চা খেতে আসা নানা লোকজনের নানা তথ্য থাকতো কাশেম মোল্লার কাছে। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের দেশীয় দোসর, রাজাকার ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্বন্ধে তথ্য দিতেন তিনি।  

বিবিসি বাজার।  ছবি: বাংলানিউজ

ক্রমেই ভিড় বাড়তে থাকে তার দোকানে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তার গড়ে ওঠে সম্পর্ক। অনেক সময় খবর পরিবেশন হয়ে যাওয়ার পর যোদ্ধারা রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসলে তিনি সেই তথ্যগুলো শুনে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের শোনাতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে রাজাকারদের খবরের ভিত্তিতে পাকিস্তানি সেনারা হানা দেয় কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে। তখন পাকিস্তানি সেনারা কাশেম মোল্লাকে গালি দিয়া বলে, ‘তুম এধার আও, তোমহারা দোকানমে রেডিও বাজতা হায়, শালে, তুমকো খতম কারদে গা, তুম রেডিও নিকালো। ’ পাকিস্তানি সেনাদের কথায় তিনি বলেন, ‘ও চিজ হামারা নেহি হে, আদমি লোক খবর লেকে আতা হে, শুনলোকে লেকে চলে যাতা হে। ’ কাশেমের কথায় তারা আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তখন হাতের রোলার আর রাইফেলের বাট দিয়ে তার পায়ে আঘাত করে। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাশেম মোল্লার খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতেন।

সন্ধ্যে হলেই রূপপুর গ্রামে হাকডাক শুরু হতো। গ্রামের লোকেরা একে অন্যেকে বলত, চল ‘বিবিসি শুনতে যাই’। এভাবে কাশেম মোল্লার চায়ের দোকানে বিবিসি খবর শোনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে আরো কয়েকশত দোকান, বিস্তার লাভ করতে থাকে পরিধি। যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ‘বিবিসি শোনার বাজার’  এবং পরবর্তীতে ‘বিবিসি বাজার’ নামে নামকরণ হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিছু উৎসাহী লোক লন্ডনে চিঠি লিখে বিবিসি কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি কাশেম মোল্লার বিষয়টি জানায়। এ কথা জেনে ১৯৯২ সালে বিবিসি’র ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাদের একটি দল বাংলাদেশে এসে কাশেম মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাত করেন। উদ্দেশ্য ছিল সরাসরি শ্রোতাদের সঙ্গে আলাপ করা। পরিদর্শন করেন বিবিসি বাজারটি। এসেছিলেন বিবিসির ইস্টার্ন সার্ভিস সেকশন প্রধান ভ্যারি ল্যাংরিজ, বাংলা বিভাগের তৎকালীন উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান, ভাষ্যকার দীপঙ্কর ঘোষ এবং বিবিসির সাবেক বাংলাদেশ সংবাদ দাতা আতাউস সামাদ।

এরপর বিবিসি বাংলা বিভাগের তৎকালীন উপ-প্রধান সিরাজুর রহমান কাশেম মোল্লা চিকিৎসা ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। তিনি লন্ডন থেকে কাশেম মোল্লার উদ্দেশ্যে বেশ কয়েক’টি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো বেশ কয়েক হাত ঘুরে কাশেম মোল্লার কাছে পৌঁছায়নি। স্বাধীনতার ৪৮ বছর পার হয়ে গেলেও তার খবর আর কেউ রাখেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তাদানকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি আবুল কাশেম মোল্লা।  

এ নিয়ে বিভিন্ন সময় তিনি দুঃখও করেছেন। না পাওয়ার এই ব্যাথা নিয়েই তিনি চলে যান না ফেরার দেশে। সেই বিবিসি বাজার এখন সরকারি করা হয়েছে, তবে কাশেম মোল্লার মারা যাওয়ার পর কেউ আর খোঁজ নেয়নি তার পরিবারেরও। তার নিজ হাতে লাগানো কড়ই গাছ বেশ মোটাতাজা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই গাছটি। হয়তো বা আরও বেশ কয়েক বছর থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।