ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

টিপুর দ্রুত ফাঁসি চান সাক্ষী ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯
টিপুর দ্রুত ফাঁসি চান সাক্ষী ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা

রাজশাহী: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সদ্য মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত টিপু রাজাকারের রায় ঘোষণার পর রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে স্বস্তি নেমে এসেছে। রায়ের পর তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন।

বুধবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে রায় প্রকাশের পরপরই বহুল আলোচিত এই মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া শহীদ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হন। আদালতের রায়ে তারা আনন্দ প্রকাশ করেন।

এ সময় আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে রায়টি দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান সাক্ষী দেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা।

এই মামলার অন্যতম সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবুর রহমান বলেন, আজকের এ রায়ে আমি আনন্দিত। কারণ প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি। টিপু রাজাকার আইসিএস এর সদস্য ছিল। এরা ছিল এলিট শ্রেণির রাজাকার। রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার পাশে মোসলেম শাহ-এর বাড়িতে টিপু রাজাকারের ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল আমি রাজশাহী ছাড়ি। যুদ্ধের সময় রাজশাহীতে রেকি করতে আসতাম। তখন টিপু রাজাকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারতাম। সে নির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড ছাড়াও অনেক হত্যার সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল।

রাজশাহীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান আরও বলেন, এসব নরপশু মানুষ হত্যা করে রাজশাহীসহ গোটা বাংলাদেশে বিভীষিকাময় অবস্থা তৈরি করছিল, স্বাধীনতাকে দুর্বিষহ করেছিল। বিজয়ের এই মাসে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হয়েছে এটি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক খুশির খবর।

এ সময় রায়টি দ্রুত কার্যকরেরও দাবি জানান রাজশাহীর এই মুক্তযোদ্ধা।

শহীদ পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী শহীদ মিনার চত্বরে জড়ো হন।  ছবি: বাংলানিউজ

মামলার আরেক সাক্ষী মো. শাহ জামান বলেন, ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আমার বাবা শহীদ বাবর মণ্ডলকে আটক করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে হলের পূর্ব দিকের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আজ রায় ঘোষিত হয়েছে। আমরা ন্যায়বিচারের আশায় এতদিন অপেক্ষা করেছি। এ রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে যেন দ্রুত রায় কার্যকরা করা হয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের মামলায় সদ্য সাজাপ্রাপ্ত রাজশাহীর বোয়ালিয়া এলাকার আব্দুস সাত্তার ওরফে টিপু রাজাকার ওরফে টিপু সুলতানকে আজ মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১০ জনকে হত্যা ছাড়াও দুইজনকে দীর্ঘ সময় আটকে রেখে নির্যাতন ও ১২ থেকে ১৩টি বাড়ি লুট করে আগুন দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামলার সাক্ষী হাসানুজ্জামান হাসানী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজশাহীতে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশাপাশি টিপু রাজাকার ও বাহিনী নির্বিচারে রাজশাহীর অনেক মানুষকে হত্যা করে। একাত্তরের ১৩ এপ্রিল আমার বাবা শহীদ সইজ্জুদ্দীন শেখকে আটক করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে নিয়ে হত্যা করা হয়। আমি তখন শিশু ছিলাম। তারা আমাকে বাবাহারা করেছে। বাবা হারানোর বেদনা আজও আমাকে তাড়া করে। আদালতের রায়ে আমরা সন্তুষ্ট। আমি নিরীহ বাঙালিদের নির্যাতনকারী সব রাজাকার বিচার চাই’।

টিপু রাজাকারের হাতে নিহত শহীদ শেখ শফিউদ্দিনের সন্তান ও মামলার সাক্ষী ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা জয়নব বেওয়াও এসেছিলেন শহীদ মিনারে প্রতিক্রিয়া জানাতে। দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। আমরাও তার মরদেহ পাইনি। বাবার হত্যাকারী টিপু রাজাকারে সর্বোচ্চ শাস্তি আশা করেছিলাম। তাই এ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ। আমি চাই সরকার যেন দ্রুত রায় কার্যকরে পদক্ষেপ নেয়’।

আর টিপু রাজাকারের বিরুদ্ধে ঘোষিত এ রায় অত্যন্ত প্রত্যাশিত ছিল উল্লেখ করে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মামলার অপর সাক্ষী হামিদা বেগম বিলকিস বলেন, ‘আদালতের রায়ে আর সবার মতো আমিও খুব খুশি। আজকে এ বিচারে আমরা আনন্দিত হয়েছি। কারণ প্রত্যাশিত রায় পেয়েছি’।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বুধবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ রায় ঘোষণা করেন।

রায় ঘোষণার জন্য মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) এই দিন নির্ধারণ করেন ট্রাইব্যুনাল। এর আগে ১৭ অক্টোবর এ মামলায় শুনানি শেষে সিএভি (রায়ের জন্য অপেক্ষমান) রাখেন।

অভিযোগ চূড়ান্তের পর তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজশাহীর টিপু রাজাকারের বিরুদ্ধে এসব অপরাধে দুইটি অভিযোগ আনা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি সেনা ও স্থানীয় রাজাকাররা। স্থানীয় সেসব রাজাকারদের মধ্যে টিপু সুলতানই বেঁচে আছেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামি জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’ পরবর্তীতে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৮৪ সালের পর থেকে রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি’ বলে উল্লেখ করেন আব্দুল হান্নান খান।

তিনি বলেন, আসামি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে পড়াশোনা করেন। ১৯৮৪ সালে নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর ডিগ্রি কলেজে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০১১ সালে অবসরে যান। ১৯৮৪ সালের পর সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও অভিযুক্ত আসামি টিপু রাজাকার জামায়াতে ইসলামীর সমর্থক।

১৯৭৪ সালের ১০ আগস্ট তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে তিনি ছাড়া পান। ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি বিস্ফোরক আইনের মামলায় রাজশাহী মহানগরীর মতিহার থানার পুলিশ তাকে ফের গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তাকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০১৯
এসএস/এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।