ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘বলেছিলাম- যুদ্ধে মরলে লাশটা মায়ের কাছে পৌঁছে দিও’ 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০১৯
‘বলেছিলাম- যুদ্ধে মরলে লাশটা মায়ের কাছে পৌঁছে দিও’ 

কুষ্টিয়া: যেদিন ট্রেনিংয়ে গেলাম সেদিনই ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে যায় পরিবার। বাবা তো আগেই মারা গিয়েছিলেন। মা আর ছোট ভাই ছিলেন বাড়িতে। রাজাকারদের অত্যাচারে তারাও ঘরছাড়া হন। মাঝে মাঝে মন খারাপ লাগতো। বাড়ির কথা মনে হলে সঙ্গী যোদ্ধাদের বলতাম- যাই হোক, যুদ্ধে যদি মরে যাই, লাশটা মায়ের কাঁছে পৌঁছে দিস। এ কথা বলেই কেঁদে ফেললেন মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক হাবিবুর রহমান সাবজান। 

হাবিবুর রহমান সাবজান কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের বড়বাড়ীয়া গ্রামের মৃত কিতাব আলী মণ্ডলের ছেলে। তিনি কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক কাকিলাদহ যুদ্ধের প্রথম গুলিবর্ষণকারী।

সম্প্রতি বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোরের কুষ্টিয়া ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জাহিদ হাসানের কাছে যুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করেন এ মুক্তিযোদ্ধা।

হাবিবুর রহমান বলেন, তখন আমি আমলা সদরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র। ৫ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৬৩ সালে বাবা মারা যান। নিয়মিতভাবে লেখাপড়া না করতে পারলেও হাল ছাড়ি না। ছোট ভাই রিয়াজ, মা আর আমি এই তিনজনের সংসার ছিল আমাদের। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন স্কুলে গিয়েছি হঠাৎ এক বন্ধু এসে বললো- তোরা সবাই বাইরে আয় মারফত ভাই ডাকছেন। মারফত ভাই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সাহসী এক সংগঠক। বাইরে গেলে তিনি বললেন, ভারতে যেতে হবে। যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। আমরা দেশকে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করবো।

‘তখন ১৮/১৯ বছরের যুবক ছিলাম। সাহস ছিল বেশ। বাড়িতে শুধু মাকে বলেই চলে গেলাম মারফত ভাইয়ের সঙ্গে ভারতে। ভারতের শিকারপুরে টু-ইঞ্চি মর্টার, এসএলআর, এলএমজি, থ্রি-নট-থ্রিসহ অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিলাম। ট্রেনিং শেষ করে কাকিলাদহের নজরুলের নেতৃত্বে আমরা দেশে ফিরি। আমরা ৫২ মুক্তিযোদ্ধা একসঙ্গে আসছিলাম। দৌলতপুরের বেদবাড়ীয়া ঘাট মাথাভাঙ্গা নদী পার হবো। ঘাটে একটা মাত্র নৌকা ছিল। এক নৌকায় তো এতো জন উঠতে পারলাম না। ২৫/২৬ জনের মতো উঠলো। বাকিরা ও পাড়েই থেকে গেলাম। জানতামই না নৌকায় পার হওয়ার খবরটা পাক বাহিনীরা জেনে গেছে। নৌকা ঘাটে ভেড়ার আগেই গোয়ালগ্রাম থেকে তারা হামলা চালায় নৌকায়। এতে প্রাণ হারায় ৭ জন। বাকিরা কোনোমতে সাঁতার দিয়ে জীবন বাঁচায়। কিন্তু রাইফেলগুলো হারিয়ে ফেলে তারা। পরে আমরা ওই জায়গা ত্যাগ করে খলিসাকুণ্ডি ঘাট হয়ে কাকিলাদহের গণির বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। পরে এলাকায় ফিরে রাজাকারদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। কষ্ট করতে হয়েছে অনেক। সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম আমরা। ’

হাবিবুর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর। মারফত ভাই আমাদের আজমপুর এলাকার তাহাজ্জেল চৌধুরির বাড়িতে ডাকেন। রাতে তাহাজ্জেলের বাড়িতে আমরা প্রায় ৫০/৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই। খবর হলো, মারফত ভাই যে এ অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও নেতা পাক বাহিনীরা সেটা জেনে গেছে। ২৮ নভেম্বর সকালের দিকে তার বাড়িতে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা পাক সেনা ও রাজাকারদের। খবরটা দিয়েছিল আমাদেরই এক মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলীর বাবা ভোলাই মালিথা। পরে সিদ্ধান্ত হয় আমরা পাক সেনাদের প্রতিহত করবো।

বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হাবিবুর রহমান।  ছবি- বাংলানিউজ

‘ঘটনার দিন খুব ভোরে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই আমরা। তাহাজ্জেল চৌধুরির মা খালি মুখে বাড়ি থেকে বের হতে দেননি। ভাত রান্নার সময় না থাকায় সবাইকে মুড়ি দেন তিনি। সেটা খেয়েই রওনা দিই আমরা।   মারফত ভাইয়ের কথায় ২৮ নভেম্বর সকালে কাকিলাদহে গিয়ে আমরা পুরো টিমকে তিন ভাগে ভাগ করি। কাকিলাদহের নজরুল, অঞ্জনগাছীর ইন্তাজ ছিলেন দুই গ্রুপের নেতৃত্বে। আর এক গ্রুপ ছিল আমার নিয়ন্ত্রণে। পুরো ৩ গ্রুপই ছিল মারফত ভাইয়ের কমান্ডে। তিনি আমাদের মাইক দিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। মারফত ভাইয়ের কথা ছিল একটাই- একজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকলেও যুদ্ধ শেষ হবে না। শেষ পর্যন্ত লড়াই করবো আমরা। ওদিকে এর মধ্যেই আক্রমণ চালায় পাক সেনা ও রাজাকাররা। তারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতেই এলএমজি দিয়ে ফায়ার শুরু করি আমি। আমার দেখাদেখি অন্যরাও গুলি শুরু করে। ’

‘সকাল ৬টা থেকে একটানা বেলা ২টা পর্যন্ত চলে সে যুদ্ধ। যুদ্ধকালীন বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীরা খবর পেয়ে যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। এদিকে খলিসাকুণ্ডি থেকে পাক সেনারাও এসে ভেড়ে। কিন্তু আমাদের ছিল দৃড় মনোবল আর সাহস। অন্যদিকে স্থানীয় গ্রামবাসীরা চারদিক থেকে রাজাকারদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কাকিলাদহের মল্লিকপাড়া দিয়ে কিছু রাজাকার পালানোর সময় গ্রামবাসীর সহায়তায় ১৪ জনকে ধরে ফেলি আমরা। সেদিনের যুদ্ধে আমাদের ১৮ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। অন্যদিকে নিহত হয় ৩৬ পাক সেনা ও ১৪ রাজাকার। ’

‘সেদিন আমার ১০০ গজ দূরেই যখন আমার বন্ধু সাদেক আলী, আর অন্যদিকে মধু মণ্ডল শহীদ হলেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। একটাই লক্ষ্য ছিল- প্রতিশোধ। জীবিত অবস্থায় আটক ১৪ রাজাকারকে তার বলি হতে হয়। সেদিনের যুদ্ধ শেষে ছত্রভঙ্গ হয়ে আমরা আত্মগোপনে চলে যাই। খেয়ে, না খেয়ে দিন কাটাতাম। বন্ধু, সহযোদ্ধারা বসে গল্প করে সময় কাটানোর চেষ্টা করতাম। বাড়ির কথা খুব মনে হতো। মা আর বাড়ির কথা মনে হলে ওই একটা কথাই বলতাম- যদি কখনো যুদ্ধে মারা যাই, তাহলে কেউ যদি বেঁচে থাকো, আমার লাশটা মায়ের কাছে পৌঁছে দিও। ’

কেবল মুক্তিযুদ্ধেই নয়, পরবর্তীতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও বীরত্ব দেখিয়েছেন হাবিবুর রহমান। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠা মিছিলে যান তিনি। সে সময় সন্ত্রাসীদের গুলির হাত থেকে আওয়ামী লীগের বর্তমান যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন এ মুক্তিযোদ্ধা।  

রাষ্ট্র এ বীর সেনানীকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে। জীবনযাপনে কখনো নীতি ও আদর্শের সঙ্গে আপোষ করেননি তিনি। চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়েকে নিয়ে তার নিরিবিলি জীবন। শুধু মাঝে মাঝে তাকে তাড়িয়ে ফেরে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ সেই দিনগুলোর স্মৃতি।  

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৫ ঘণ্টা, ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৯
জেডএইচজেড/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।