ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘যুদ্ধে মরে গেলে লাশটা তোরা মায়ের কাছে পৌঁছে দিস’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৫, ২০১৯
‘যুদ্ধে মরে গেলে লাশটা তোরা মায়ের কাছে পৌঁছে দিস’

কুষ্টিয়া: ‘যেদিন ট্রেনিং এ গেলাম তখনই ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে যায় পরিবার। বাবা তো আগেই মারা গিয়েছিলেন। মা আর ছোট ভাই ছিল বাড়িতে। রাজাকারদের অত্যাচারে তারাও ঘর ছাড়া হয়। মাঝে মাঝে মন খারাপ লাগতো। আমাদের সবারই বাড়ির কথা যখন মনে হতো তখন আমরা যুদ্ধের সাথীদের বলতাম ‘যুদ্ধে যা হয় হোক, যদি যুদ্ধে মরে যায় তাহলে লাশটা তোরা মায়ের কাছে পৌঁছে দিস’।

কথাগুলো বলার সময় চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান সাবজান। তিনি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের বড়বাড়ীয়া গ্রামের মৃত কিতাব আলী মণ্ডলের ছেলে।

কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক কাকিলাদহ যুদ্ধের প্রথম গুলিবর্ষণকারী  তিনি।

বাংলানিউজের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হাবিবুর রহমান সাবজান বলেন, তখন আমি আমলাসদরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৬৩ সালে বাবা মারা যান। নিয়মিত লেখাপড়া না করতে পারলেও হাল ছাড়িনি। ছোট ভাই রিয়াজ, মা আর আমি। এই তিনজনের সংসার ছিল আমাদের। একদিন স্কুলে গিয়েছি হঠাৎ এক বন্ধু বললো ‘তোরা সবাই বাইরে আয় মারফত ভাই ডাকছে। ’ মারফত ভাইয়ের কাছে গেলাম। মারফত ভাই বললেন, ‘ভারতে যেতে হবে। যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে। আমরা দেশকে পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করবো। ’ তখন ১৮/১৯ বছরের যুবক ছিলাম। সাহস ছিল বেশ। বাড়িতে শুধু মাকে বলেই চলে গেলাম মারফত ভাইয়ের সঙ্গে ভারতে। ভারতের শিকারপুরে টুইঞ্চি মর্টার, এসএলআর, এলএমজি, থ্রি নাট থ্রি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিলাম।

ভারতের শিকারপুর যুদ্ধের ট্রেনিং শেষ করে কাকিলাদহের নজরুলের নেতৃত্বে ফিরে আসছিলাম দেশে। আমরা ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধা একসঙ্গে আসছিলাম দৌলতপুরের বেদবাড়ীয়া ঘাট মাথাভাঙ্গা নদী পার হবো বলে। ঘাটে একটা মাত্র নৌকা ছিল। এক নৌকায় তো এতজন উঠতে পারলাম না। ২৫/২৬ জনের মতো উঠলো। আমরা বাকিরা ওপারে থেকে গেলাম। জানতামই না নৌকায় পার হওয়ার খবরটা পাক বাহিনীরা জেনে গেছে। নৌকা ঘাটে ভেড়ার আগেই গোয়ালগ্রাম থেকে হানাদার বাহিনীরা হামলা চালায় নৌকায়। এতে প্রাণ হারান সাতজন মুক্তিযোদ্ধা। বাকিরা নদীতে সাঁতার দিয়ে জীবন বাঁচায়। রাইফেল গুলো হারিয়ে যায়। পরে আমরা স্থান ত্যাগ করে খলিসাকুণ্ডি ঘাট হয়ে কাকিলাদহের গণির বাড়িতে সেল্টার নিলাম। এলাকায় এসে রাজাকারদের ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। কষ্ট করতে হয়েছে অনেক। সুযোগের অপেক্ষায় থাকতাম আমরা।

তিনি বলেন, সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর। মারফত ভাই আমাদের আজমপুর এলাকার তাহাজ্জেল চৌধুরির বাড়িতে ডাকে। রাতে তাহাজ্জেলের বাড়িতে আমরা প্রায় ৫০/৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা একত্রিত হই। খবর ছিল মারফত ভাই এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ও নেতা এটা পাকবাহিনীরা জেনে গেছে। ২৮ নভেম্বর সকালে মারফত ভাইয়ের বাড়িতে আক্রমণ চালাবে পাকসেনা ও রাজাকাররা। খবরটা দিয়েছিল আমাদেরই এক মুক্তিযোদ্ধা সাদেক আলীর বাবা ভোলাই মালিথা। পরে সিদ্ধান্ত হয় আমরা পাক সেনাদের প্রতিহত করবো। খুব ভোরে প্রস্তুতি নেয় যুদ্ধে যাওয়ার। তাহাজ্জেল চৌধুরির মা খালি মুখে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়নি। ভাত রান্নার সময় না থাকায় এক মুঠো করে মুড়ি দেয়। সেটা খেতে খেতেই রওনা দিলাম আমরা।

মারফত ভাইয়ের কথায় ২৮ নভেম্বর সকালে কাকিলাদহে গিয়ে আমরা পুরো দলকে তিনটি ভাগে ভাগ করি। কাকিলাদহের নজরুল, অঞ্জনগাছীর ইন্তাজ ছিল দুই গ্রুপের নেতৃত্বে। আর এক গ্রুপ ছিলো আমার নিয়ন্ত্রণে। পুরো তিন গ্রুপই মারফত ভাইয়ের কমান্ড মেনে চলছিল। মারফত ভাই হ্যান্ডমাইক দিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। সেদিন মারফত ভাইয়ের কথা ছিলো একটায় ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে থাকলেও যুদ্ধ শেষ হবে না। শেষ পর্যন্ত লড়াই করবো আমরা’। এরমধ্যে আক্রমণ চালায় পাকসেনা ও রাজাকাররা। তারা আমাদের দিকে অগ্রসর হতেই এলএমজি দিয়ে ফায়ার শুরু করি আমি। আমার দেখা দেখি অন্যরাও ফায়ার করে।

সকাল ৬টা থেকে একটানা দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে এ যুদ্ধ। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীরা খবর পেয়ে যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। এদিকে, খলিসাকুণ্ডি থেকে পাকসেনারাও আসে। আমাদের ছিল দৃঢ় মনোবল আর সাহস। স্থানীয় গ্রামবাসীরা চারদিক থেকে রাজাকারদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এসময় কাকিলাদহের মল্লিকপাড়া দিয়ে কিছু রাজাকার পালিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামবাসীর সহায়তায় ১৪ জন রাজাকারকে আমরা ধরে ফেলি। যুদ্ধে আমাদের ১৮ জনের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। আমরা ৩৬ জন পাকসেনা, ১৪ জন রাজাকারকে হত্যা করি।

১৪ জন রাজাকারকে হত্যার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ১০০ গজ দূরে যখন শহীদ হলো আমার বন্ধু সাদেক আলী অপরদিকে মধু মণ্ডল তখন নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। একটাই লক্ষ্য ছিল শত্রুদের হত্যা করা। তাই জীবিত ধরা ১৪ রাজাকারকে খালের ধারে গুলি করে, পিটিয়ে হত্যা করি। তাদের সেখানেই মাটিচাপা দিয়ে শহীদ সাদেক ও মধুমণ্ডলের মরদেহ নিয়ে এসে আজমপুরে বাঁশ বাগানে কবর দেয়। এরপর আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আত্মগোপন করি।

তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের দিনগুলি খেয়ে না খেয়ে রাত কাটাতাম। বন্ধু, সহযোদ্ধারা বসে গল্প করতাম। বাড়ির কথা মনে হতো। একে অপরকে বলতাম যে, যদি কখনো যুদ্ধে মারা যায়, তাহলে কেউ যদি বেঁচে থাকি তাহলে সে যেন লাশটা মায়ের কাছে পৌঁছে দেয়।

১৯৭১ সালের বীর এ যোদ্ধা শুধু মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেই নয়। বীরত্ব দেখিয়েছেন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধেও। ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের লগি বৈঠা মিছিলে যান তিনি। এসময় বিএনপি ও সন্ত্রাসীদের গুলির হাত থেকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফকে বাঁচাতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।  

স্ত্রী, এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক এই বীর সৈনিক। তিন মেয়েরই বিয়ে দিয়েছেন তিনি। স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়েই কাটে তার সময়। এখনো চাষাবাদের মধ্যে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। রাষ্ট্র এই বীর সেনাকে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তবে আজও তিনি ভুলতে পারেননি ভয়াবহ যুদ্ধের দিনগুলি।

বাংলাদেশ সময়: ১২০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।