ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রাজস্থলী-রাইখালী!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রাজস্থলী-রাইখালী!

রাঙামাটি: সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে রাঙামাটির রাজস্থলী এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়ন। কয়েকমাস ধরে প্রতিদিন এসব এলাকায় ঘটছে খুন, গুম, চুরি-ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ। এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকায় অপরাধ হরহামেশা ঘটছে।

নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে জানা যায়, রাজস্থলী এবং কাপ্তাইয়ের রাইখালী ইউনিয়ন অনেক দুর্গম হওয়ায় সন্ত্রাসীরা এসব এলাকায় তাদের অপকর্মের অভয়ারণ্য হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করছে। প্রতিদিন এলাকাগুলোতে কোনো না কোনো ঘটনা লেগেই থাকে।

অনেক ঘটনা প্রশাসনের নজরে আসে না। আর এলেও অনেক পরে বা ঘটনার পরের দিন জানতে পারে।

নিরাপত্তা কাজে জড়িত সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব এলাকায় এক সময় বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়নামারের সশস্ত্র গ্রুপ ‘আরাকান লিবারেশন আর্মি’র আনাগোনা এবং তাদের প্রভাব ছিল। বর্তমানে এসব এলাকায় ‘সন্তু গ্রুপে’র নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসি-জেএসএস), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক (বর্মা গ্রুপ), আরকান আর্মির সহযোগী ‘মগ লিরাবেশন পার্টি’ এবং ‘মগ লিরাবেশন পার্টি সংস্কার’ নামে সংগঠনগুলো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনী তৎপরতা সবসময় অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এলাকা অনুযায়ী নিরাপত্তা বাহিনী সঙ্কট এবং যথাযথ স্থানে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপিত না থাকায় অপরাধের সংখ্যা বাড়ছে এবং ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছে।

তথ্য মতে- রাজস্থলী উপজেলার উত্তরে কাপ্তাই উপজেলা, দক্ষিণে বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলা এবং বান্দরবান সদর, পূর্বে বিলাইছড়ি উপজেলা এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলা।

এসব অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের আনাগোনা বেশি হয় মূলত বান্দরবান জেলার দুর্গম রোয়াংছড়ি উপজেলা হয়ে। প্রশাসনের হাত থেকে বাঁচতে সন্ত্রাসীরা এ রুটকে নিরাপদ ভেবে চলাচল করে।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন তথ্য থেকে জানা যায়, বিগত কয়েক বছর ধরে রাজস্থলী এবং কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নটি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

চলতি বছরের ১৮ আগস্ট রাজস্থলী আর্মি ক্যাম্পের দক্ষিণে পোয়াইতুমুখ এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। এতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য নাসিম গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় আরও একজন আহত হন। একই দিন বিকেলে ওই এলাকায় অভিযান চালানোর সময় মাইন বিস্ফোরণে আরও দুইজন আহত হন।

অক্টোবর মাসের ২৩ তারিখে রাজস্থলী উপজেলার হেডম্যান দীপময় তালুকদারকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় থানায় মামলা দায়ের করা হলেও অপরাধীরা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

৮ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসি-জেএসএস) সশস্ত্র ক্যাডার অংসুঅং মারমা নামে এক যুবকে গুলি চালিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ গ্রুপ।

চলতি মাসের ১৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের বালুমুড়া মারমা পাড়া এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) তিনজন সশস্ত্র ক্যাডারকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

চলতি মাসের ২০ তারিখে রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের লংগদু পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একদল সন্ত্রাসী চাঁদার টাকা না পাওয়ায় বিদ্যালয় ভবন কাজে কর্মরত শ্রমিকদের পিটিয়ে একজন সাব-ঠিকাদারসহ দু’জন শ্রমিককে আহত করে।

এদিকে সন্ত্রাসীরা চাঁদা না পেয়ে নভেম্বর মাসের ২১ তারিখ বিকেলে কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী ইউনিয়নের কৃষিফার্ম ভালুকিয়া সড়ক উন্নয়ন কাজে জড়িত ১০ শ্রমিককে পিটিয়ে আহত করে। ২০ তারিখ রাতে একই ইউনিয়নের হাফছড়ি এলাকায় তিনটি বাড়ি এবং একটি দোকান লুট করে সন্ত্রাসীরা।

২১ তারিখের গভীর রাতে একই ইউনিয়নের মতিপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীরা ব্যাংক কর্মকর্তা উচিং মারমা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্যের বাড়িতে হামলা চালিয়ে নগদ ২৫ লাখ টাকা, ৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুট করে পালিয়ে যায় এবং বাড়ির মালিক উচিং মারমাকে পিটিয়ে জখম করে।

এ বিষয়ে ওই ব্যাংক কর্মকর্তা উচিং মারমা বাংলানিউজকে বলেন, প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের হুমকির ভয়ে থাকি। কখন প্রাণটা কেড়ে নেবে। সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে আমরা মুক্তি চাই। ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করতে পারছি না। সরকার যদি এ এলাকায় নজর দেয় এবং নিরাপত্তা জোরদার করে তাহলে সন্ত্রাসীরা এ এলাকায় থাকতে পারবে না।

রাইখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এনামুল হক শামীম বাংলানিউজকে বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলা, নগদ টাকা ও মালামাল লুট করায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বারবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলার পরও কোনো কাজ হচ্ছে না। ঠিকই এসব সন্ত্রাসীরা রাতের বেলায় এসে হামলা করে। তাই স্থানীয়রা মামলা করতে ভয় পাচ্ছে।

কাপ্তাই উপজেলার অধীন চন্দ্রঘোনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আশরাফ উদ্দীন বাংলানিউজকে জানান, আমরা যেখানে তথ্য পাচ্ছি সেখানে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। তবে এলাকাগুলো দুর্গম হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে একটু বেগ পেতে হয়। মূল সমস্যা হলো সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এখানে কেউ মামলা করে না। মামলা করলে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে আরও সহজ হবে।

রাজস্থলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মফজল আহম্মেদ খান বাংলানিউজকে বলেন, সন্ত্রাসবাদ কোনো জাতির জন্য আর্শিবাদ নয়। আমরা প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা এবং অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যেসব ঘটনায় কেউ মামলা করে না সেসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে সন্ত্রাসীদের ধরছে। তবে এজন্য স্থানীয় জনগণকে সচেতন এবং সহযোগিতা করার মনোভাব থাকতে হবে।

রাজস্থলী উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উবাচ মারমা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রাজনৈতিক বিভিন্ন সভা-সেমিনারে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছি এবং স্ব-স্ব এলাকায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি। সন্ত্রাসীরা এতো শক্তিশালী হয়নি রাষ্ট্রের শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে।  প্রশাসনের একার পক্ষে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। এজন্য স্থানীয়দের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।

পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বাংলানিউজকে বলেন, অপরাধীদের ধরতে পুলিশ সব রকম অভিযান অব্যাহত রেখেছে। প্রয়োজনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৯, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।