ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কেন ট্রেড ইউনিয়ন চান না মালিকরা?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৫, ২০১৯
কেন ট্রেড ইউনিয়ন চান না মালিকরা? কর্মস্থলে যাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। ছবি: বাংলানিউজ

সাভার (ঢাকা): শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, মালিকপক্ষের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক এবং শ্রমিক শ্রেণীর কল্যাণে আইন স্বীকৃত সংগঠনই হলো ট্রেড ইউনিয়ন। দেশে প্রচলিত শ্রম আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন থাকা বাধ্যতামূলক করেছে সরকার।

শ্রমিক নেতারা বলছেন, সাভারের রানা প্লাজা ধসের আগে বাংলাদেশের প্রধান শিল্প পোশাক খাতে ট্রেড ইউনিয়নের ধারা খুবই কম ছিল। কিন্তু বর্তমানে গুটি কয়েক পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন হলেও অজানা কারণে বেশ কয়েকটি কারখানার মালিক এর বিপক্ষে।

এসব পোশাক করাখানাগুলোতে মালিকদের জন্যই ট্রেড ইউনিয়ন হচ্ছে না।

শ্রম অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সব খাতে ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৩১৫টি ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন করা হয়েছে। যার মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২০৮ টি, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৯২ টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০২ টি ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন করা হয়।

জানা গেছে, শ্রমিকেরা তৈরি পোশাক কারখানায় ইউনিয়ন করার কারণে বরখাস্ত হওয়াসহ প্রতিনিয়ত নানা ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। অসৎ শ্রম আচরণ, ব্যবস্থাপনা ও ভাড়াটে গুণ্ডাদের হাতে মৌখিক বা শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে প্রায়ই।

সম্প্রতি ট্রেড ইউনিয়নের কারণে আশুলিয়ার দুটি কারখানায় চাকরি হারানো পোশাক শ্রমিকেরা বাংলানিউজকে বলেন, মালিকরা চান না তাদের কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হোক। কারণ ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে শ্রমিকদের যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে চালাতে পারবেন না। শ্রমিকদের বাৎসরিক ছুটিসহ নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। আর এটি থাকলে কারখানা ট্রেড ইউনিয়নে যে আইন আছে সে অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। শ্রমিকদের কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে পারবেন না। আশুলিয়ার ইউফোরিয়া নামে একটি পোশাক কারখানার ফটকের সামেন ছাঁটাই শ্রমিকদের ছবি টানিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।  ছবি: বাংলানিউজ তবে অভিযোগ আছে খোদ ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়েও। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক শ্রমিক নেতাই ব্যক্তিস্বার্থে মালিকপক্ষের হয়ে কাজ করেন। এজন্য ইউনিয়নগুলোকে দাঁড় করানো সম্ভব হয় না।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পোশাকশ্রমিক বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আছে। তবে তারা মালিকদেরই কথা শোনে, শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবে না। এর মধ্য শ্রমিকরা কারখানায় আরেকটি ট্রেড ইউনিয়ন করার কথা ভাবলে শ্রমিক প্রতিনিধি ও শ্রম অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা মালিকের সঙ্গে সমঝোতা করে ট্রেড ইউনিয়নটির আবেদন বাতিল করে দিয়েছে। পাশাপাশি একসঙ্গে ৯৬ জন শ্রমিককে ছাঁটাই করে দেয়। এদিকে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে বেশিরভাগ মালিকের মধ্যেই অনীহা কাজ করে বলে জানিয়েছেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা।

তারা বাংলানিউজকে বলেন, পাট শিল্প ধ্বংসের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন দায়ী ছিল বলে অজুহাত দেন মালিকরা। যদিও বাস্তবে শিল্প টেকসই করতে ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজন রয়েছে। তবে মালিকরা প্রভাব খাটিয়ে এ বিষয়টিকে দমিয়ে রাখতে চান। এ কারণে শিল্প টেকসই হয় না।

‘মালিকপক্ষ এখন পর্যন্ত এ মানসিকতা থেকে বের হতে পারেননি। ট্রেড ইউনিয়নের তৎপরতা দেখলেই ছাঁটাইসহ নানা কৌশল ও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে আবেদন বাতিল করা হয়। ’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন বাংলানিউজকে বলেন, একটি কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে শ্রমিক-মালিক উভয়পক্ষই লাভবান হয়। মালিকের উৎপাদন বাড়ে আর শ্রমিক ন্যায়সংগত অধিকার পায়। এক কথায়, শ্রম আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা হয়। যে কারখানায় বেসিক ইউনিয়ন থাকে সেখানে বিশৃঙ্খলা-অসন্তোষ হয় না।

‘কিন্তু বর্তমানে পোশাক কারখানার মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করতে চান না। বিভিন্ন কৌশলে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে বাধা দেন মালিকরা। সেই সঙ্গে যে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে চায়, তাদের চিহ্নিত করে ছাঁটাই করা হয়। মূলত মালিকরা ভাবেন, ট্রেড ইউনিয়ন করলে তাদের মুনাফা কমে যাবে, কারখানায় অসন্তোষ হবে, কারখানা নিজের মতো থাকবে না ইত্যাদি। এটি একদমই ভুল ধারণা। ’

তিনি বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে কারখানা ভালোভাবে চলে শ্রমিকরা-মালিকের অধিকার আদায় হয়, কারখানার উৎপাদন বৃদ্ধি হয়।

এদিকে, ট্রেড ইউনিয়ন না করার কারণ  হিসেবে কারখানার মালিক ও কর্মকর্তারা জানান, কারখানার শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করেন না। মূলত ট্রেড ইউনিয়ন করে বাইরের শ্রমিক নেতারা। যদি কোনো কারখানায় শ্রমিকরা নিজ উদ্যোগে ট্রেড ইউনিয়ন চায়, কারখানার মালিকের এখানে কিছুই বলার থাকবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কারখানার কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন কারখানার শ্রমিকরা কেউ করে না। মূলত শ্রমিকরা জানেই না ট্রেড ইউনিয়ন কী? এখানে কিছু শ্রমিক নেতা তাদের স্বার্থ লাভের জন্য শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শ্রম অধিদপ্তরের কারখানার ট্রেড ইউনিয়নের জন্য আবেদন করে। শ্রমিক নেতাদের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন করা মানে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাওয়া। বিষয়টি মূলত শ্রমিক নেতাদের হাতে রিমোট দিয়ে কারখানার ভেতরে বোমা রাখার মতো। তখন শ্রমিক নেতারা যা দাবি করবে সেটাই মানতে হবে। শুধু শ্রমিক নেতাদের পকেট ভরবে, অথচ শ্রমিকরা কোনো সুযোগ সুবিধা পাবে না।

তিনি বলেন, কিছু অসাধু শ্রমিক নেতারা ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে ব্যবসা করছে। এখন কিছু কিছু শ্রমিক নেতা আছে যারা ট্রেড ইউনিয়নের জন্য আবেদন করে না। তারা আবেদন করে টাকা ইনকামের জন্য। ট্রেড ইউনিয়ন আমরাও চাই, কিন্তু সেটাতে যেন শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা পায়, শ্রমিকরা যেন সঠিক অধিকার পায়।

বিষয়টি নিয়ে নাবা নিটওয়্যার লিমিটেডের মালিক এনায়েত উদ্দিন মোহাম্মদ কায়সার খান বাংলানিউজকে বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন হলে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। শ্রমিকরা যদি সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করতো, কোনো ঝামেলা ছিলো না। গত একবছরে আমাকে না জানিয়ে শ্রমিক নেতারা দু’বার ট্রেড ইউনিয়নের নাম করে টাকা নিয়েছে কারখানা থেকে।

‘আবার সবাই মিলে ট্রেড ইউনিয়ন বাদও দিয়েছে। এটি শ্রমিক নেতাদের বর্তমান ব্যবসা। তারা শ্রমিকদের বিক্রি করে টাকা কামাচ্ছ। এই ট্রেড ইউনিয়ন কেলেঙ্কারির সঙ্গে শুধু শ্রমিক নেতারা জড়িত না, এখানে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও জড়িত। শ্রম মন্ত্রণালয় ও ট্রেড ইউনিয়নের লোকজন মিলে হুমকি দেয় কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য। তখন কিছু টাকা দিলে ছয় মাস তারা চুপচাপ থাকে। ’

এই চক্রের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, শ্রমিক, শ্রমিক নেতা ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের লোকজন যদি ট্রেড ইউনিয়ন করতে চায়, করুক। এতে যদি কারখানা চালাতে পারি চালাবো নয় তো বন্ধ করে দেবো।

এদিকে কোনো কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন করতে রাজি হলেই সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হবে বলে জনিয়েছেন শ্রম অধিদপ্তরের পরিচালক শেখ বেলাল হোসেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, কেবলমাত্র শ্রমিকরা চাইলেই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সম্ভব।

‘তারা ট্রেড ইউনিয়নে সমর্থন দিলে মালিকরা এখানে কিছু করতে পারবেন না। অনেক সময় শ্রমিকদের হয়ে শ্রমিক নেতারা ট্রেড ইউনিয়নের জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনে যদি কোনো কারচুপির চিহ্ন পাওয়া যায়, তাহলে আমরা সেই আবেদন বাতিল করে দেই। ’

তিনি বলেন, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে দুর্নীতির যথাযথ প্রমাণ নিয়ে কেউ অভিযোগ দিলে এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১১১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৫, ২০১৯
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।