ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

১৩ মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ১৮৪, থামছে না ইয়াবার চালান

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
১৩ মাসে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ১৮৪, থামছে না ইয়াবার চালান

কক্সবাজার: গত বছরের ৪ মে থেকে এ পর্যন্ত শুধু কক্সবাজারে তিন নারীসহ ১৮৪ মাদককারবারি নিহত হয়েছেন ‘বন্দুকযুদ্ধে’। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এবং কারবারিদের নিজেদের মধ্যে বিরোধের জেরে তারা নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আবার দুই নারীসহ ৪৭ জন রোহিঙ্গা।

অন্যদিকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের হাতে অস্ত্র ও ইয়াবা তুলে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন ১০২ জন ইয়াবা গডফাদার ও ব্যবসায়ী। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না।

তবে স্থানীয়রা বলছেন, ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালান এখন অনেকটা রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির পরও এ অপকর্ম বন্ধ করা যাচ্ছে না। এছাড়া বর্তমানে এমন কোনো অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘঠিত হচ্ছে না।

সর্বশেষ গত সোমবার (২৮ অক্টোবর) কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীর পাটুয়ারটেক সমুদ্র সৈকত এলাকা থেকে ৪০ কোটি টাকা মূল্যের ৮ লাখ পিস ইয়াবার একটি বড় চালান উদ্ধার করেছে র‌্যাব। এটি এ যাবতকালে ধরাপড়া বৃহৎ চালানগুলোর অন্যতম বলে জানিয়েছে র‌্যাব। এসময় মো. জামাল হোসেন (২২) নামে এক রোহিঙ্গাকেও আটক করে র‌্যাব। আটক জামাল টেকনাফের উনছিপ্রাং রোহিঙ্গা শিবিরের ক্যাম্প ২২-এর আওতাধীন ডি ব্লকের মো. হোছনের ছেলে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে। উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি শরণার্থী শিবির এখন পরিণত হয়েছে ইয়াবার ‘নিরাপদ জোনে’। উখিয়া-টেকনাফের অন্তত ৩০টি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আসে। এরপর এগুলো ক্যাম্পে মজুদ করে। পরে সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচার করা হয় এসব ইয়াবা।

তারা আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের মুখে উখিয়া-টেকনাফের অনেক বড় বড় ইয়াবা ডন বর্তমানে পলাতক। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ইয়াবাকারবারি রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে তাদের ব্যবসা অব্যাহত রেখেছে।  

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। অন্যদিকে স্থানীয় কিছু লোকজনও তাদের ব্যবহার করছে। এটা ঠিক। কিন্তু এটা আর বেশি দিন চলবে না। রোহিঙ্গাদের অপরাধ দমনে কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে অস্ত্র, মানবপাচার, মাদক, অপহরণ, ডাকাতি, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ৪৭১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে ১ হাজার ৮৮ রোহিঙ্গাকে। মামলাগুলোর মধ্যে ২০৮টিই মাদক মামলা। এসব মাদক মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৬৮ জনকে।

এছাড়া অন্য মামলার মধ্যে রয়েছে- অস্ত্র মামলা ৩৬টি, হত্যা মামলা ৪৩টি, ফরেনার্স অ্যাক্টে ৩৭টি, ডাকাতি ৯টি, পুলিশের ওপর হামলা ১টি, অপহরণ ১৫টি, মানবপাচার ২৪টি, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা ৩১টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ২১টিসহ বিভিন্ন অপরাধে আরও ৪৬টি মামলা হয়েছে।  
 
কক্সবাজার পুলিশের হিসাব মতে, গত বছরের ৪ মে সারাদেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবির সঙ্গে ইয়াবাকারবারিদের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ এবং ইয়াবাকারবারিদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে সংঘর্ষে কক্সবাজার জেলায় এ পর্যন্ত তিন নারীসহ ১৮৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দুই নারীসহ ৪৭ জন রোহিঙ্গা।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের মধ্যে টেকনাফে নাফ নদী ও পাহাড়ি সংলগ্ন বালুখালী কাটা পাহাড়, ধামনখালী, রহমতের বিল, আনজুমান পাড়া, ডেইল পাড়া, পূর্ব ডিগলিয়া ও চাকবৈটা-করইবনিয়া, নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশফাঁড়ি, আমতলী গর্জনবুনিয়া, ফাত্রাঝিরি, তুমব্রু ও ঘুমধুম এবং টেকনাফের উলুবনিয়া, হউসের দিয়া, উনচিপ্রাং, হ্নীলা, লেদা, মোচনী, ট্রানজিট ঘাট, দমদমিয়া, সাবরাং, খুরের মুখ, শাহপরীর দ্বীপ, লম্বা বিলসহ অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ব্যবহার করে রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসছে।

কক্সবাজারের এয়ারপোর্ট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মাস্টার মোস্তাক আহমদ বলেন, সাগরে মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় গত ৯ অক্টোবর থেকে সাগরে নামতে পারছে না এদেশের জেলেরা। অথচ মাছ ধরার নৌকায় করে মিয়ানমার থেকে বড় বড় ইয়াবার চালান নিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। বিষয়টি আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের।  

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। এমন অবস্থা চলমান থাকলে স্থানীয়দের উদ্বাস্তু হতে বেশি দিন সময় লাগবে না।

তিনি আরও বলেন, নানা অপরাধের পাশাপাশি রোহিঙ্গারা এখন ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এত কড়াকড়ির পরও ইয়াবা পাচাররোধ করা যাচ্ছে না। এটা আমাদের জন্য আরেকটা হুমকি।  

‘রোহিঙ্গাদের কারণে সমাজে নানা অস্থিরতা তো আছেই, এ ইয়াবার কারণে এখন পারিবারিক কলহ, সামাজিক বিবাদ ও বিশৃঙ্খলা দিনকে দিন বাড়ছে। ’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) উখিয়া শাখার সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিকদার বাংলানিউজকে জানান, উখিয়া-টেকনাফে প্রায় প্রতিদিন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মাদককারবারি, সন্ত্রাসী নিহত হচ্ছে। কিন্তু এত কড়াকড়ির পরও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না।

সবচে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, মানবতার কথা বিবেচনা করে যাদের এখানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সেই রোহিঙ্গারাই এখন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।  

তার মতে, উখিয়ার বালুখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, টেকনাফের লম্বাবিল, উলুবুনিয়াসহ বেশ কিছু সীমান্ত পয়েন্ট আছে, যেগুলো রোহিঙ্গা শিবিরের সঙ্গে একদম লাগোয়া। এসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা নিয়মিত মিয়ানমারে যাতায়াত করে।

‘এমনকি প্রতি রাতেই রোহিঙ্গারা এসব পয়েন্ট দিয়ে বিপুল সংখ্যক ইয়াবা নিয়ে আসে এবং আশপাশের ক্যাম্পের ভেতরে মজুদ করে। সেখান থেকে রোহিঙ্গা গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্নস্থানে এগুলো পাচার করা হয়। ’

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি সরকার যথেষ্ঠ আন্তরিক। কিন্তু এই সুযোগে এরা যদি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তা কঠোরভাবে দমন করা হবে।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে তাদের অপরাধ দমনে এবং ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৯
এসবি/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।