ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘অস্তিত্ব’ না থাকলেও এমপিওভুক্ত জনতা বাণিজ্য কলেজ!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩১১ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৯
‘অস্তিত্ব’ না থাকলেও এমপিওভুক্ত জনতা বাণিজ্য কলেজ! জনতা কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজের সাইনবোর্ড, ছবি: বাংলানিউজ

নেত্রকোনা: নিয়মিত কার্যক্রম, নিজস্ব জমি এবং ভবন- কোনোটিই নেই, অথচ মান্থলি পেমেন্ট অর্ডারভুক্ত (এমপিও) হয়েছে নেত্রকোনার মদন উপজেলার নামমাত্র একটি কলেজ। এতে উপজেলাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের পাশাপাশি তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তা নয়, কলেজ এমপিওভুক্তির পদ্ধতিও তাদের কাছে এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

শুধু নামে আছে, কাজে নেই- এমন একটি কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে- অভিযোগ পেয়ে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘জনতা কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজ’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্প্রতি এমপিওভুক্ত করে সরকার। অথচ কলেজটি কোনো কার্যক্রমে নেই।

স্থানীয়দের অভিযোগ- উল্লিখিত নামের কলেজটির নেই নিজস্ব ভবন বা ভূমি। কলেজের ঠিকানা দেখানো হয়েছে উপজেলার তিয়শ্রী ইউনিয়নের বালালি গ্রাম। কিন্তু বালালি গ্রামে এ নামে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম দূরে থাক, এমপিওভুক্তির আগ পর্যন্ত নামই শুনেনি তারা।

বালালি গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান ও জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, এ গ্রামে জনতা কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজ এমপিওভুক্ত হয়েছে জানতে পেরেছি। কিন্তু কলেজটি বাস্তবে কোথায় আমরা গ্রামবাসী তা জানি না। গ্রামে এ নামে কোনো কলেজ কোনোদিন দেখিওনি আমরা। বিষয়টি খুবই আশ্চর্যের; বাস্তবে কলেজ নেই কিন্তু এমপিওভুক্ত হলো!

অথচ এই উপজেলায়ই নিজস্ব ভূমিতে তিনতলা বিশিষ্ট ভবনে প্রতিষ্ঠিত ‘বালালি বাঘমারা শাহজাহান মহাবিদ্যালয়’ এমপিওভুক্ত হয়নি! স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা শাহ্জাহান উদ্দিন ভূঁইয়া গড়ে তুলেছিলেন। আর এরপর থেকে কলেজটি সফল শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।

বালালি বাঘমারা শাহজাহান মহাবিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা রুকন উদ্দিন। একইসঙ্গে তিনি কলেজটির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রী নিয়ে নিয়মিত শিক্ষা কর্মসূচি চালিয়েও কলেজটি এমপিওভুক্ত তালিকায় স্থান পায়নি। অস্তিত্ব নেই একটি কলেজ এমপিওভুক্ত হয়ে যায়। এটা খুবই দুঃখের বিষয়। এ নিয়ে উপজেলার ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শুরু করে সবার মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা বলছেন, যে প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি জরুরি, সেটা হলো না। যে কলেজের এখনই প্রয়োজন নেই, সেটি পেলো এমপিওভুক্তি।

গ্রামটির বাসিন্দা উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান, একসময় শুনেছিলাম বালালি গ্রামের আব্দুল আজিজ নামে একজন কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজ খুলেছেন। তবে সেটি তিয়শ্রী ইউনিয়নের বালালি গ্রামে নয়, তা শতভাগ নিশ্চিত। এছাড়া কোথায় করেছেন তাও কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এমপিওভুক্ত হয়েছে বালালি গ্রামের ঠিকানায়।
বালালি বাঘমারা শাহজাহান মহাবিদ্যালয়, ছবি: বাংলানিউজস্থানীয়দের মতে এমপিওভুক্ত অস্তিত্বহীন কলেজটির সন্ধ্যান খুঁজতে বের হয় বাংলানিউজ। অনুসন্ধানে বালালিসহ এর আশপাশের কোনো গ্রামেই পাওয়া যায়নি এ নামে কোনো কলেজের সন্ধান।

দিন শেষে মদন পৌর এলাকায় কাজী জসিম উদ্দিন নামে এক ব্যক্তির ঝোপঝাড় ঘেরা ভুতুড়ে একটি বাড়িতে দেখা মেলে জনতা কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজের ‘তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র’ নামে একটি সাইনবোর্ড।

রাস্তাঘাট খুঁজে বের করে সাইনবোর্ড সংবলিত বাড়ির ঘরে গিয়ে দেখা যায় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ছোট একটি কক্ষে শিক্ষকদের বসার জন্য রাখা আছে ছয়টি চেয়ার। রয়েছে নামমাত্র তিনটি শ্রেণিকক্ষ। এতে ছয়টি করে ১৮টি বেঞ্চ রয়েছে। যেগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে ধুলা আর গাছের ঝরা পাতা।

সেখানে কলেজটির অধ্যক্ষ পরিচয় দিয়ে আরিফুল রহমান খান বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন। উপস্থিত ছিলেন কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক পরিচয় দেওয়া নূরে আলম সিদ্দিকিও। তাদের দাবি, প্রায় এক যুগ আগে বালালি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ জনতা কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শিক্ষক ও কর্মচারী মিলে প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে জনবল ১১ জন। এছাড়া বালালি গ্রামে প্রতিষ্ঠানটির নামে ৫০ শতক জায়গা রাখা আছে। সেখানে দ্রুত ঘর তৈরি করা হবে।

তারা এও দাবি করেন, এ প্রতিষ্ঠানে ২৯৫ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে কলেজ শাখায় ১৭২ জন আর স্কুল শাখায় ১২৩ জন। তবে স্কুল শাখাটি এ বছর থেকেই শুরু করা হয়েছে। এছাড়া এ বছর বিএমএ শাখা থেকে ৭২ জন পরীক্ষা দিয়ে ৬২ জন পাস করেছে। গতবছর পাসের হার ছিল ৮৬ শতাংশ। শিক্ষার প্রয়োজনীয় উপকরণসহ শিক্ষার্থীর উপস্থিত কম থাকলেও কলেজে নিয়মিত ক্লাস হয়।

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমান, খেটে খাওয়া মানুষ রফিকুল ইসলাম ও জাহাঙ্গীর আলম। বাংলানিউজকে তারা জানান, কয়েকবছর আগে জরাজীর্ণ ভাড়া বাড়িটিতে কলেজটিকে কোনোরকম লোকদেখানো একটি আকার দিতে চেয়েছিল সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু পারেনি। শুধু ভর্তি ও ফরম পূরণের সময় বাসাটিতে কয়েকজন এসে রুমগুলো খোলে বসেন।

স্থানীয়দের অভিযোগের বিষয়ে জানতে কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল আজিজের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বারবার তার মোবাইলে কল দেওয়া হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ওয়ালীউল হাসান বাংলানিউজকে বলেন, জনতা কারিগরি ও বাণিজ্য কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম শুনেছি। তবে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম আছে কি-না, সে বিষয়ে আমার জানা নেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৩ অক্টোবর দুপুরে গণভবনে দেশের দুই হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির ঘোষণা দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৮, ২০১৯
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।