ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আদালত প্রাঙ্গণে নুসরাত হত্যার রায়ের অপেক্ষা

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
আদালত প্রাঙ্গণে নুসরাত হত্যার রায়ের অপেক্ষা আদালত প্রাঙ্গণে রায়ের অপেক্ষা

ফেনী: ফেনী জজ কোর্টের চিত্রটা অন্যদিনের চেয়ে ভিন্ন। সকাল ৯টা থেকে আদালত চত্বরে বাড়ছে উৎসুক জনতার সমাগম। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে মিডিয়াকর্মীদের আনাগোনা। পাশাপাশি আদালত প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হচ্ছেন মানবাধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সবার অপেক্ষা কখন হবে বহুল আলোচিত নুসরাত হত্যা মামলার রায়।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ফেনী জেলা কারাগার থেকে বের করা হয়েছে ১৬ আসামিকে। ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করবেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক মামুনুর রশিদ।  

মাত্র সাড়ে ছয় মাসের মাথায় নিষ্পত্তি হতে চলেছে বর্বরোচিত এ হত্যা মামলা। বিশ্ব মিডিয়ায় বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের রায় ঘিরে দেশের সব মহলের নজর আজ ফেনীর আদালতে।

ইতোমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা ফেনীতে অবস্থান করছেন। আদালত অঙ্গন ও আশপাশের এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। একইভাবে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে নুসরাত রাফির গ্রামের বাড়ি সোনাগাজী পৌর শহরের উত্তর চরছান্দিয়ায়।

ঘটনার সূত্রপাত হয় চলতি বছরের ২৭ মার্চ। ওইদিন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে একটি মামলা করেছিলেন নিহত নুসরাতের মা শিরিন আখতার। সেদিনই অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার অনুগত কিছু ক্যাডার জনমত গঠন করে সিরাজ উদ-দৌলাকে জেল থেকে বের করে আনার জন্য। এরপর তারা সিরাজ উদ-দৌলাকে মুক্ত করার জন্য রাস্তায় আন্দোলনও করেন।

কারাগারে থাকা অবস্থায় ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে পরামর্শ করে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে খুনিরা পরিকল্পিতভাবে সাইক্লোন সেন্টারের ছাদে নিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়।  

ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় ফেনী ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। ওই হাসপাতালে তার অবস্থার অবনতি হলে নুসরাতকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসা চলে নুসরাতের।

এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনকে আসামি করে ও অজ্ঞাতপরিচয় বোরকা পরা চারজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ১০ এপ্রিল মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হস্তান্তর করা হয়। সেদিন রাতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নুসরাত। মৃত্যুর আগে ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ দিয়ে যায় সে। তার সেই ডিক্লারেশনের ক্লু-ধরেই এগুতে থাকে মামলাটি। এক করে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।

১১ এপ্রিল নুসরাতের মরদেহ আনা হয় তার বাড়িতে। সোনাগাজী সাবের পাইলট হাইস্কুল মাঠে তার নামাজে জানাজার পর অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে সমাহিত করা হয়। নুসরাতের জানাজাটি ছিল লোকে লোকারণ্য। লাখো মানুষ তার জানাজায় অংশগ্রহণ করে খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছিল। এরপর একে একে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয় ২১ জনকে। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ১২ জন। ২৮ মে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আদালত ৫ জনকে বাদ দিয়ে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করে ১৬ জনকে। নুসরাত হত্যায় পুলিশের অবহেলার অভিযোগে ১৩ মে প্রত্যাহার করা হয় ফেনীর তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) জাহাঙ্গীর আলম সরকারকে। থানায় হেনস্তা হওয়ার নুসরাতের ভিডিওটি প্রকাশ হওয়ার পর ৮ মে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেয়াজ্জেমসহ পুলিশের দুই উপ-পরিদর্শককে (এসআই) বহিষ্কার করা হয় ৮ মে। এরপর তার নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। ১৬ জুন তাকে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

১০ জুন অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। এরপর ২০ জুন চার্জ গঠন হয়। ২৭ জুন থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়, ৯০ জন সাক্ষীর মধ্যে সাক্ষ্য দেন মোট ৮৭ জন। দীর্ঘ ৪৭ দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল যুক্তিতর্ক। চলে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ৩০ সেপ্টেম্বর আদালত রায়ের জন্য ২৪ অক্টোবরকে নির্ধারণ করেন। মামলাটিতে মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক গ্রহণ করা হয়।  

সাক্ষীদের সাক্ষ্যপ্রমাণ ও পিবিআইয়ের তদন্তে প্রতীয়মান হয় ছাদে কিলিং মিশনে অংশ নেয় ৫ জন। কারাগার থেকে হত্যার নির্দেশ দেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ্য সিরাজ উদ-দৌলা। আর অর্থ যোগানদাতা ছিলেন তৎকালীন উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রহুল আমীন ও কাউন্সিলর মাকসুদ। গেট ও সিঁড়ি পাহারায় ছিল বাকি আসামিরা।

রাফির মা শিরীন আক্তার হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, ঘটনার পরপরই পুলিশ ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা করলেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পিবিআই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করে। একইসঙ্গে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলাটির বিচারকাজ শেষ পর্যায়ে আসায় তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। এ ঘটনায় দোষীদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে আর কোনো রাফি যেন বর্বরতার শিকার না হয়।

জানতে চাইলে ফেনীর পুলিশ সুপার মো. নুরন্নবী বলেন, আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় কেন্দ্র নুসরাত রাফির বাড়িতে আরও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা সতর্ক রয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
এসএইচডি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।