ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

নুসরাত হত্যার রায়: দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তিতে নজির স্থাপন!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
নুসরাত হত্যার রায়: দ্রুত সময়ে নিষ্পত্তিতে নজির স্থাপন!

ফেনী: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার মেধাবী ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছে পুরো দেশকে। নৃশংস এ হত্যার খবর স্থান করে নিয়েছে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) নৃশংস সেই হত্যার মামলার রায় ঘোষণা করা হবে।

এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) দুপুরে রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে রায়ের এ তারিখ ঘোষণা করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক মো. মামুনুর রশিদ।

চলতি বছরের ১০ জুন মামলার অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে আসামিদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ আদালত। সেদিন থেকে মোট ৬১ কার্যদিবস চলে মামলার কার্যক্রম। এ সময়ের মধ্যে চলে ৮৭ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ, আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন, রাষ্ট্র ও বাদীপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন।

এত অল্প সময়ে রায় ঘোষণা হওয়ায় নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে মামলাটি। নুসরাতের পরিবার, আইনজীবী ও ফেনীর সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে স্বস্তি। সবার একটাই চাওয়া ‘অভিযুক্ত দোষী সব আসামির যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়’।

আদালত সূত্র, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মাত্র ৬১ কার্যদিবসে মামলাটি নিষ্পত্তি হতে চলেছে। এত অল্প সময়ে কোনো মামলা এর আগে নিষ্পত্তি হয়নি। আইনজীবীরা বলেন, সাধারণ মামলাতো দূরের কথা- দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালেও এত দ্রুত সময়ে আর কোনো বিচার নিষ্পত্তি হয়নি। এটি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে মাইলফলক সৃষ্টি করছে।

নুসরাত জাহান রাফির আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও ফেনী জজ কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহজাহান সাজু বলেন, মামলাটি তার আইন পেশার ‘বিরল অভিজ্ঞতা’, মাত্র ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ আসামির সাক্ষ্যগ্রহণ এবং যুক্তিতর্ক গ্রহণ। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসেও নেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে এমন চাঞ্চল্যকর মামলার নিষ্পত্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।

একই ধরনের মন্তব্য করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ সাইফুল আলম। তিনি বলেন, নুসরাত হত্যা মামমলার রায়টি বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। এর আগে কোনো দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালেও এত দ্রুত সময়ে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার নজির নেই। এ মামলার সঙ্গে জড়িত বিচার প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান তিনি।

ফেনী জজ কোর্টের পিপি হাফেজ আহম্মদ বলেন, ‘নুসরাত যাতে ন্যায়বিচার পায়, আসামিদের যাতে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় সেজন্য শতভাগ তৎপর ছিল রাষ্ট্রপক্ষ। মামলার বিচারকের ব্যাপারে তিনি বলেন, ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার কারণেই মামলাটি এত দ্রুত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারও ঘোষণা ছিলো খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়।  

চলতি বছরের ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা।

৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আট জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় তাকে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; যা মৃত্যুশয্যায় নুসরাত বলে গেছেন। ১০ এপ্রিল ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুসরাতের মৃত্যু হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।

২৮ মে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিআইবি) কর্মকর্তারা। সেদিন অভিযোগপত্রসহ মামলার নথি বিচারক ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে পাঠিয়ে দেন। এরপর ৩০ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আসামিদের হাজির করা হলেও বিচারক সেদিন অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি না করে ১০ জুন শুনানির তারিখ ধার্য করেন।

পরে ১০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন।

অভিযোগপত্রের ১৬ আসামি হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল। মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অন্য পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করে পিবিআই। আদালত তা অনুমোদন করেন। তারা হলেন- নুসরাতের সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ জনি, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ও শাহিদুল ইসলাম।

মামলার চার্জশিট জমা দেওয়ার আগে ৭ জন সাক্ষী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলায় গ্রেপ্তার মাদ্রাসারা অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের ও জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।

এছাড়া যৌন হয়রানির মামলার পর নুসরাতের জবানবন্দি গ্রহণের সময় তার ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে সাইবার আইনে মামলা হওয়ার পর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৬১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৯
এসএইচডি/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।