ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

‘খুনিদের এমন শাস্তি হোক যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৩, ২০১৯
‘খুনিদের এমন শাস্তি হোক যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়’

ফেনী: ‘হাঁসি দিলেতো টক্কুশ করি মরি যাইবো, হেগুনেরে য্যান হুড়ি মারা অয়, হেগুনে বুঝক আঁর মাইয়া কত কষ্ট হাইছে (ফাঁসি দিলেতো বিনা কষ্টে মারা যাবে, তাদের যেন পুড়িয়ে মারা হয়, যেন তারা বোঝে, আমার মেয়ে কত কষ্ট পেয়েছে)।

আগামী ২৪ অক্টোবর আলোচিত নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার আগে এমনই আকুতি ঝরলো তার মা শিরিন আখতারের কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে। মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) বিকেলে সোনাগাজী পৌর শহরের বাড়িতে তার সঙ্গে কথা বলছিল বাংলানিউজ।

নুসরাতের মা বলেন, আমার মেয়ে রাতে-দিনে ১০ দিন যে কষ্ট করছে, এক টুকরো অক্ষত মাংস নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারেনি, সেই যন্ত্রণা যেন খুনিদেরও দেওয়া হয়।

‘আমি আমার কলিজার টুকরা মেয়ে হত্যার দৃষ্টান্তমূক শাস্তি চাই। এমন শাস্তি হোক, যেন পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়। ’

গত ২৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের দায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে আটক করে পুলিশ। পরে ৬ এপ্রিল ওই মাদরাসা কেন্দ্রের সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় অধ্যক্ষের সহযোগীরা।

৮ এপ্রিল নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আট জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে বলা হয় মামলায়। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় নুসরাতের। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক’দিনের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করা হয় আসামিদের।

নুসরাতের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে শিরিন আখতার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতা আর দিক-নির্দেশনা না থাকলে এত দ্রুত সময়ে হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া সম্ভব হতো না। তিনি আমাদের পাশে ছিলেন বলেই আসামিদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আমাদের খেয়াল না করলে আমাদের অস্তিত্বও থাকতো না। প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, এ হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। আমি সে কথাটি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে রায়ের জন্য অপেক্ষা করে আছি।

আসামিপক্ষ থেকে হুমকি-ধামকির ব্যাপারে নুসরাতের মা বলেন, আসামিরা হুমকি দিচ্ছে, তারা নুসরাতের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ফেলবে, ঘরে বাতি দেওয়ার মত কোনো লোক থাকবে না। নুসরাতের কবর থেকে লাশ গায়েব করার হুমকিও দিচ্ছে তারা। বাঁয়ের ছবিতে দগ্ধ নুসরাত, ডানের ছবিতে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলানিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারে শিরিন আখতার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পুলিশ আমাদের পাহারা দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে, রায় কার্যকর হওয়া পর্যন্ত যেন এ নিরাপত্তা থাকে।

হুমকিদাতাদের ব্যাপারে নির্দিষ্টভাবে কিছু না বললেও নুসরাতের মা বলেন, মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার পর জেলে থেকে কী বাকি রেখেছে সে? সে একাই আমার মেয়েকে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করেছে। আর এখনতো ১৬ আসামি, তারা ইচ্ছে করলে আমাদের বড় ক্ষতি করে ফেলতে পারে।

শিরিন আখতার বলেন, যতজন অপরাধী আমার মেয়ে হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।  

তিনি তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘হাঁসি দিলেতো টক্কুশ করি মরি যাইবো, হেগুনেরে য্যান হুড়ি মারা অয়, হেগুনে বুঝক আঁর মাইয়া কত কষ্ট হাইছে (ফাঁসি দিলেতো বিনা কষ্টে মারা যাবে, তাদের যেন পুড়িয়ে মারা হয়, যেন তারা বোঝে, আমার মেয়ে কত কষ্ট পেয়েছে)।

আসামিদের গ্রেফতার ও তদন্তের পর গত ২৮ মে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে ১৬ জনকে আসামি করে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। সেদিন অভিযোগপত্রসহ মামলার নথি বিচারক ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে পাঠিয়ে দেন। এরপর ৩০ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আসামিদের হাজির করা হলেও বিচারক সেদিন অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি না করে ১০ জুন শুনানির তারিখ ধার্য করেন।

পরে ১০ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ফেনীর পরিদর্শক মো. শাহ আলম আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র জমা দেন। এ ১৬ আসামি হলেন- মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, আওয়ামী লীগ নেতা ও মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল।  

মামলায় মোট ২১ জনকে গ্রেফতার করা হলেও তদন্তে সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় অন্য পাঁচ জনকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।  

অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, উম্মে সুলতানা পপি, কামরুন নাহার মনি, জাবেদ হোসেন, আবদুর রহিম শরীফ, হাফেজ আবদুল কাদের, জোবায়ের আহমেদ, এমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা ও মহিউদ্দিন শাকিল আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দি, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক শুনানির পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায় ঘোষণার জন্য ২৪ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক মামুনুর রশিদ।

অন্যদিকে, অধ্যক্ষের যৌন হয়রানির বিষয়ে নুসরাতের অভিযোগ গ্রহণের সময় তার ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনেরও বিচার চলছে। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২২, ২০১৯
এসএইচডি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।