ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দীর্ঘদিন ধরেই পদ্মায় ইলিশ ধরছিলেন ভারতীয় জেলেরা!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৫৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৯
দীর্ঘদিন ধরেই পদ্মায় ইলিশ ধরছিলেন ভারতীয় জেলেরা!

রাজশাহী: সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে ইলিশ শিকার করছিলেন ভারতীয় জেলেরা। শূন্যরেখা অতিক্রম করে ৬০০ থেকে ৬৫০ গজ ভেতরে অনুমতি ছাড়াই অনুপ্রবেশের পর নিষিদ্ধি সময়ে মা ইলিশ শিকারকে কেন্দ্র করে গত ১৭ অক্টোবর বিএসএফ-বিজিবির মধ্যে গুলির ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনা দীর্ঘদিন ধরেই ঘটিয়ে চলেছিলো ভারতীয় জেলেরা। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহীর চারঘাট সীমান্তে শূন্যরেখা অতিক্রম করে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে চার বিএসএফ সদস্য। আর যে জায়গাটিতে তারা এসেছিল, সেটি বড়াল নদের উৎসমুখের একদম কাছেই।

আবার ভারতীয় জেলেকে ছাড়িয়ে নিতে প্রথমে বিএসএফ-ই গুলি করে। এ সময় আত্মরক্ষায় ফাঁকা গুলি ছোড়ে বিজিবি। এ ঘটনার পর থেকে রাজশাহীর চারঘাট সীমান্তে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী।  

এছাড়া সীমানায় ঢুকে নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ শিকার ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে মৎস্য অধিদফতর। গত ৮ অক্টোবর থেকে আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করেছে সরকার। এ সময়ে ইলিশের আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে। এ আইন অমান্য করলে জেল অথবা জরিমানা এমনকি উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

নিষেধাজ্ঞা জারি করে মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বলছে, এ সময়ে ৮০ শতাংশ মা ইলিশ ডিম ছাড়ে। একটি বড় ইলিশ ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়তে পারে। আর এই ডিম পাড়ে মূলত মিঠা পানিতে। তাই আশ্বিনের পূর্ণিমার চারদিন আগে এবং পূর্ণিমার পর ১৮ দিন মোট ২২ দিন দেশের উপকূলীয় অঞ্চল, নদীর মোহনাসহ যেসব জেলা ও নদীতে ইলিশ পাওয়া যায়, সেখানে মাছ ধরা বন্ধ থাকবে। তবে এ সময় যেসব জেলার জেলেরা মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল, তাদের খাদ্য সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে।


আটক ভারতীয় জেলে।  ছবি: বাংলানিউজমা ইলিশ সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে বর্তমানে মাছটি আহরণ বন্ধ রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইলিশ আহরণের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে।  

‘মা ইলিশ সংরক্ষণ কর্মসূচি’র আওতায় মৎস্য কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রতিদিন পদ্মা নদীতে অভিযান পরিচালনা করছে বিজিবি।  

এ অবস্থায় বাংলাদেশি জেলেরা মা ইলিশ শিকার থেকে বিরত রয়েছেন। তবে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পদ্মানদীতে নেমে মাছ ধরছেন ভারতীয় জেলেরা! সীমান্ত পেরিয়ে তারা ঢুকে পড়ছেন বাংলাদেশের জলসীমায়। এ ঘটনায় রাজশাহীর পদ্মা নদীতেই এক ভারতীয় জেলেকে কারেন্ট জালসহ আটক করা হয়েছে।  

পালিয়ে গেছে আরও দুই ভারতীয় জেলে। আটক জেলের বিরুদ্ধে রাজশাহীর চারঘাট থানায় মধ্যে দুইটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটিতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ ও অন্যটিতে নিষিদ্ধ সময়ে মা ইলিশ শিকারের অভিযোগ আনা হয়েছে। ওই মামলায় তিনি এখন রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন।  

এর আগে গত ৪ অক্টোবরের পর দুইদিনের ব্যবধানে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে মাছ ধরার অভিযোগে ৩৮ ভারতীয় জেলেকে আটক করে নৌবাহিনী।  

মংলা বন্দরের অদূরে তিনটি ট্রলারসহ বঙ্গোপসাগরের ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকা ও তার আশপাশের এলাকা থেকে আটক করা হয় এসব জেলেকে।

রাজশাহী বিজিবি-১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ফেরদৌস জিয়াউদ্দিন মাহমুদ বলেন, গত বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) সীমান্ত পিলার থেকে ৬০০ মিটার বাংলাদেশের ভেতরে তিন জেলেকে মাছ শিকার করতে দেখে আটকের চেষ্টা করে বিজিবি।  

এদের মধ্যে দুই জেলে পালিয়ে যান এবং একজনকে মাছ ধরার কারেন্ট জালসহ আটক করা  হয়। এরা তিনজনই ভারতীয় নাগরিক ছিলেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ১১৭ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কাগমারী ক্যাম্প থেকে চারজনের একটি টহল টিম স্পিডবোটে করে ঘটনাস্থলে আসে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশে বিএসএফ সদস্যরা বিজিবির অনুমতি নেননি। শূন্য রেখা অতিক্রম করে অবৈধভাবে পদ্মা নদীর পাড়ে বিজিবি সদস্যদের কাছে আসার পরও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে।  

বিজিবি ওই টহল টিমের সদস্যরা আটক ভারতীয় জেলেকে পরে নিয়ম অনুযায়ী পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত দেওয়া হবে বলেও বিএসএফ সদস্যদের জানানো হয়। কিন্তু অনুপ্রবেশ করা বিএসএফ সদস্যরা ভারতীয় ওই জেলেকে বিজিবির কাছ থেকে নিয়ে মারধর শুরু করেন। তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন।

এতে বিজিবি সদস্যরা বাধা দিলে বিএসএফ সদস্যরা বিজিবিকে লক্ষ্য করে আনুমানিক ৬ থেকে ৮ রাউন্ড গুলি করে। আত্মরক্ষার জন্য বিজিবির টহল দল ফাঁকা গুলি করে। তখন বিএসএফ সদস্যরা গুলি করতে করতে দ্রুত ঘটনাস্থল ছেড়ে চলে যান।

লে. কর্নেল ফেরদৌস জিয়াউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিজিবি এখন সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সীমান্তে নজর রাখা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশিদেরও সতর্ক করা হয়েছে। রাজশাহীর যেসব উপজেলায় ভারতীয় সীমান্ত রয়েছে সেসব উপজেলা প্রশাসনকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও অনুরোধ জানানো হয়েছে। তারা ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এলাকায় মাইকিং করে সবাইকে সতর্ক করেছেন।

ভারতীয় গণমাধ্যমে ‘পতাকা বৈঠকে ডেকে গুলি করা হয়েছে’ এমন খবর প্রচারের বিষয়ে রাজশাহী বিজিবি-১ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফেরদৌস জিয়াউদ্দিন মাহমুদ বলেন, পতাকা বৈঠকের প্রশ্নই আসে না, কারণ সেটি করতে গেলে আনুষ্ঠানিকতার বিষয় আছে। এ বিষয়টি তাদের কমান্ড্যান্টও বলেননি। বৈঠক একটাই হয়েছে, সেটি ঘটনার পর; বিকেলে আমার আর বিএসএফ কমান্ড্যান্টের মধ্যে।

তিনি বলেন, ‘পতাকা বৈঠকে এত কিছু হওয়ার সুযোগ ছিল না। পতাকা বৈঠক স্বাধীনতার পর থেকে হয়ে আসছে। আর বিজিবি প্রায় আড়াইশ বছরের পুরাতন একটি বাহিনী। পতাকা বৈঠকে এ ধরনের ঘটনা ঘটার কোনো সুযোগ নেই। তারা পতাকা বৈঠকে আসবেন আর তাদের ওপর অতর্কিত হামলার কোনো কারণ নেই। ‘

এদিকে, ওই ঘটনার পর প্রকাশ পায় ঘটনাস্থলের একটি ছবি। ওই ছবিতে দেখা যায়, বিএসএফের চার সদস্য ইউনিফর্ম না পরেই স্পিডবোটে করে ঘটনাস্থলে আসেন। অবৈধভাবে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। তাই এ সময় পতাকা বৈঠকের কথা বলায় তারা তাৎক্ষণিকভাবে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন এবং গুলি ছোড়েন।

রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রজনন মৌসুম হওয়ায় এখন নদীতে মা ইলিশ শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলছে। প্রতিদিনই বিজিবির সহায়তায় নদীতে অভিযান চালানো হচ্ছে। নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার সকালেও বিজিবি সদস্যদের নিয়ে পদ্মা নদীতে অভিযান চালানো হয়।  

‘এ সময় পদ্মা ও বড়ালের মোহনায় বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে একটি নৌকায় তিনজন ভারতীয় জেলে কারেন্ট জাল দিয়ে মা ইলিশ ধরছিলেন। তাদের আটক করতে গেলে দু’জন ভারতীয় অংশে পালিয়ে যান এবং অপরজনকে আটক করা হয়। ’ 

তিনি বলেন, এ ঘটনার পরপরই বিএসএফ সদস্যরা এসে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি শুরু করেন। তারা ওই জেলেকে নিয়ে মারধর শুরু করেন এবং তাকে নিয়ে যেতে চান। এর প্রতিবাদ করলে বিএসএফ-ই বিজিবিকে লক্ষ্য করে প্রথম গুলি ছোড়ে। এ ঘটনার পর আমরা পদ্মা নদীতে আরও বেশি নজরদারি শুরু করেছি।  

রাজশাহীর চারঘাট পৌর মেয়র জাকিরুল ইসলাম বিকুল বলেন, সীমান্ত এলাকাগুলো এখন স্বাভাবিক আছে। প্রথমদিন আতঙ্ক ছড়ালেও এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সীমান্ত এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে সেজন্য এলাকাবাসী সচেতন রয়েছে।  

স্থানীয়দের সতর্ক থাকতেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই পৌরমেয়র।  

আরও পড়ুন-

>> কী ঘটেছিল চারঘাট সীমান্তে?
>> আটক ভারতীয় জেলের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশসহ দুই মামলা 
>> ভারতীয় জেলেকে থানায় হস্তান্তর, তদন্তে বিজিবি-বিএসএফ
>> পদ্মায় ভারতীয় জেলেদের ইলিশ শিকার: বিজিবি-বিএসএফ গুলিবিনিময়

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৯, ২০১৯
এসএস/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।