ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

শুদ্ধি অভিযানের এক মাস: ‘রাঘব বোয়াল’সহ জালে ১৮

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
শুদ্ধি অভিযানের এক মাস: ‘রাঘব বোয়াল’সহ জালে ১৮

ঢাকা: দলমত নির্বিশেষে দেশজুড়ে চলছে ‘শুদ্ধি অভিযান’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতের অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা ও অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে তৎপরতা শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা। তবে, এ বিশেষ অভিযানে সরাসরি দায়িত্ব পালন করছে এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে র‌্যাব, যাকে সরকার ঘোষিত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ অভিযান শুরু থেকেই পেয়েছে ব্যাপক জনসমর্থন, জনমনে সৃষ্টি করেছে আস্থা।

এক মাস ধরে চলমান এ অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটসহ গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে। নগদ সাড়ে আট কোটি টাকাসহ জব্দ করা হয়েছে প্রায় ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর।  

র‌্যাব সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ১১টি ক্যাসিনো/ক্লাবে অভিযান পরিচালনা করেছে র‌্যাব, যার মধ্যে রাজধানীতে আটটি ও চট্টগ্রামে রয়েছে তিনটি। এসব ক্লাব থেকে উদ্ধার করা ক্যাসিনো সামগ্রীর দাম কয়েক কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত এক মাসে ক্লাব, বাসাবাড়ি ও অফিসসহ মোট ১৯টি স্থানে অভিযান চালানো হয়েছে।  
বিভিন্ন ক্লাবে অভিযান চালিয়ে পাওয়া যায় ক্যাসিনোসামগ্রী।  ফাইল ফটোঅভিযান চালানো ক্লাবগুলো হলো- ফকিরাপুল ইয়ং মেনস ক্লাব, ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ, কলাবাগান ক্রীড়া চক্র, ধানমন্ডি ক্লাব, ফু-ওয়াং ক্লাব এবং চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, আবাহনী ক্লাব, মোহামেডান ক্লাব।  

অভিযানে এক মাসে সুপরিচিত আটজনসহ গ্রেফতার করা হয়েছে ১৮ জনকে। এছাড়া, বিভিন্ন ক্যাসিনোতে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে ২০১ জনকে আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।  

র‌্যাব এ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ প্রায় ৮ কোটি ৪৫ লাখ নগদ অর্থ জব্দ করেছে। উদ্ধার করা হয়েছে ১৬৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার এফডিআর, ১৩২টি বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও ৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক। ৭ দশমিক ২০ ভরি অলংকার (৮ কেজি) জব্দ করা হয়েছে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় চার কোটি টাকা। এছাড়া, অবৈধ বা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের অভিযোগে মোট ২৫টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি, বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ও বিদেশি মদ উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  
জি শামীমের অফিসে অভিযানে বিপুল পরিমাণ টাকা-মদ উদ্ধার।  ফাইল ফটোঅভিযান শুরুর দিন ১৮ সেপ্টেম্বর বিকেলে ফকিরাপুলের ইয়ং মেনস ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র‌্যাব। ওইদিন রাতেই একে একে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্যাসিনোর সন্ধান পায় তারা। ওই রাতেই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গুলশানের বাসা থেকে অস্ত্র ও মাদকসহ আটক করেন র‌্যাব সদস্যরা।

২০ সেপ্টেম্বর আরেক যুবলীগ নেতা ‘টেন্ডারবাজ’খ্যাত জি কে শামীমকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এসময় তার অফিস থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর উদ্ধার করা হয়। ওইদিন রাতে রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্র ও ধানমন্ডি ক্লাবে অভিযান চালানো হয়, গ্রেফতার করা হয় কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষকলীগ নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে।  

২৬ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর মনিপুরী পাড়ার বাসায় অভিযান চালিয়ে মাদকসহ আটক করা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ও মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। ৩০ সেপ্টেম্বর দুপুরে বিদেশে পালানোর সময় থাইল্যান্ডগামী একটি প্লেন থেকে আটক করা হয় ‘অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা’ সেলিম প্রধানকে। ইয়ং মেনস ক্লাবে পাওয়া ক্যাসিনো সামগ্রী।  ফাইল ফটোঅভিযানের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে ৬ অক্টোবর। এদিন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (পরে বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে কুমিল্লা থেকে আটক করে র‌্যাব। পরে, সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে রাজধানীতে তার অফিস ও কয়েকটি বাসায় অভিযান চালানো হয়। সবশেষ ১১ অক্টোবর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানকে শ্রীমঙ্গল থেকে আটক করা হয়।
 
অভিযানে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ইসমাইল হোসেন সম্রাটের অফিসে টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়। যেখান থেকে নির্যাতনের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন আকারের লাঠি ও ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মেশিন জব্দ করা হয়েছে।
 
এই এক মাসের অভিযানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মোট ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার নামে গুলশান থানায় তিনটি (অস্ত্র, মাদক, মানি লন্ডারিং) ও মতিঝিল থানায় মাদক আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকা ওয়ান্ডার্স ক্লাবে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় মাদক আইনে মতিঝিল থানায় একটি মামলা, জি কে শামীমের নামে গুলশান থানায় তিনটি (অস্ত্র, মাদক, মানি লন্ডারিং) মামলা, শফিকুল আলম ফিরোজের নামে ধানমন্ডি থানায় অস্ত্র আইনে একটি ও গুলশান থানায় মাদক আইনে একটি মামলা, এনামুল হক ও তার ভাই রুপন ভূঁইয়াসহ সহযোগীদের নামে গেন্ডারিয়া থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি, সূত্রাপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে দু’টি, বিশেষ ক্ষমতা আইনে দু’টি, ওয়ারী থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি ও অস্ত্র আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।  
সম্রাটের অফিস থেকে উদ্ধার মাদক উদ্ধার।  ফাইল ফটোফু-ওয়াং ক্লাবে মাদক উদ্ধারের ঘটনায় তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দু’টি মামলা, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ ও বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার নামে তেজগাঁও থানায় মাদক আইনে একটি মামলা, অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধানসহ তিনজনের নামে গুলশান থানায় মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে দু’টি মামলা, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের নামে রমনা মডেল থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনে দু’টি মামলা এবং কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় এনামুল হক আরমানের নামে মাদক আইনে একটি মামলা, হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের নামে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থানায় অস্ত্র আইনে একটি ও রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
 
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ১১টি মামলার তদন্ত করছে র‌্যাব। খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার দু’টি, জি কে শামীমের দু’টি, শফিকুল আলম ফিরোজের দু’টি, ফুয়াং ক্লাবের দু’টি, সেলিম প্রধানের একটি ও সম্রাটের দু’টি মামলার তদন্তভার পেয়েছে র‌্যাব।  

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের বিষয়ে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বাংলানিউজকে বলেন, অভিযানের কারণে এখন সারাদেশের কোথাও ক্যাসিনো নেই। এর সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট অনেক হর্তাকর্তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
 
বর্তমানে এ অভিযান কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অভিযান ঝিমিয়ে পড়েছে বলার অবকাশ নেই। ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে যে অভিযান শুরু করেছিলাম, সেক্ষেত্রে আমরা শতভাগ সফল। ক্যাসিনোর সঙ্গে জড়িত অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। ভবিষ্যতে আর কারও সম্পৃক্ততা পেলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৮, ২০১৯
পিএম/একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।