ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

স্বেচ্ছায় রোদ-বৃষ্টি জয় করেন ‘আয়ূব ট্রাফিক’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২১ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
স্বেচ্ছায় রোদ-বৃষ্টি জয় করেন ‘আয়ূব ট্রাফিক’ আয়ূব আলী। ছবি: বাংলানিউজ

কুষ্টিয়া: বাঁশির ফুৎকার আর ছোট্ট হাওয়ায় লাঠির ছন্দ তার নিত্যসঙ্গী। যেন রোদ, ঝড়, বৃষ্টিও হার মানে সেই ছন্দ আর গতিতে। প্রখর রৌদ্রে মাথায় ক্যাপ চাপিয়ে সে ছন্দ-গতিতে নিজ ঘরের চুলায় নিয়মিত আগুন জ্বালাতে না পারলেও তার জন্য শ্রদ্ধার আলো জ্বলে হাজারও মানুষের মনে। তিনি আয়ূব আলী; সাধারণ মানুষ যাকে ভালোবেসে ‘ট্রাফিক’ বলে ডাকে!

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কুষ্টিয়া-মেহরপুর মহাসড়কের আমলা বাজারের চার রাস্তার মোড়ের ব্যস্ত ‘ট্রাফিক’ তিনি। ৬৪ বছর বয়সেও যিনি সারাদিন ব্যস্ত থাকেন মানুষকে সাহায্য করতে।

তবে তা অর্থ দিয়ে নয়, নিরাপদ সড়কের প্রতিশ্রুতিতে।

এলাকার আমলা বাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে তিনি ‘আয়ূব ট্রাফিক’ নামেই বেশি পরিচিত। সাধারণ জনগণকে নিরাপদ সড়ক উপহার দিতে স্বেচ্ছায় জীবনের দীর্ঘ সময় তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন এ বাজারেই। ব্যস্ত সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি নিরাপদে রাস্তা পার হওয়া শিখিয়েছেন হাজারও শিশু-কিশোরকে।

তেমনি এক শিক্ষার্থী সুমাইয়া জামান পড়েন আমলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কথা হলে সে বাংলানিউজকে বলে, আয়ূব দাদা খুবই ভালো। সে আমাকে প্রতিদিন রাস্তা পার করে দেয়। বাড়ি থেকে আব্বু-আম্মুও আমাকে বলে দেয়, একা একা রাস্তা পার না হয়ে আয়ূব দাদাকে বললেই সে রাস্তা পার করে দেবে।

শুধু শিক্ষার্থীই নয়, চালক এবং সাধারণ মানুষও সন্তুষ্ট ‘আয়ূব ট্রাফিকে’র প্রতি। এ বিষয়ে স্থানীয় আমলা বাজারের অটো চালক রিন্টু বাংলানিউজকে বলেন, এটা একটি ব্যস্ততম সড়ক হলেও আয়ূব আলীর কারণে কোনো যানজটে পড়ে না। সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। তিনি আছের বলেই এই সড়কে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে পথচলি। আর শরীর সুস্থ্য থাকলে বছরের একটা দিনও ছুটি কাটাতে দেখিনি তাকে! 

চালক ও সাধারণ মানুষও সন্তুষ্ট আয়ূব আলীর ওপর।  ছবি: বাংলানিউজ

স্থানীয় আমলা সদরপুর বহুমুখী বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও আমলা পাবলিক লাইব্রেরির সভাপতি মকবুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আয়ূব আলী দীর্ঘদিন ধরেই স্বেচ্ছায় এই সড়কে ট্রাফিকের ভূমিকা পালন করে আসছেন। এতে ব্যস্ত এই সড়কটি যেমন অত্যন্ত নিরাপদ, তেমনি এখানে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগণও সড়ক সচেতনতা সম্পর্কে জানতে পারে।

সরেজমিনে দেখা যায়, মুখে বাঁশি এবং হাতে লাঠি নিয়ে চার রাস্তার মোড়ে তিনি তৎপর থাকেন সবসময়। নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন আমলা বাজারের ট্রাফিক জ্যাম। ছোট-বড় গাড়িগুলো বাজার অতিক্রম করার সময় তিনি চেষ্টা করেন সড়ক নিরাপদ রাখার। বিশেষ করে যাত্রীবাহী বাস আসলে যাত্রীদের ওঠানামার ক্ষেত্রেও সহযোগিতা করেন তিনি।

উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এই আমলায় দুইটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুইটি কিন্ডারগার্টেন, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি বালিকা বিদ্যালয়, একটি সরকারি কলেজসহ বেশ কিছু প্রাইভেট কোচিং সেন্টার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে প্রতিদিন প্রায় তিন থেকে চার হাজার শিক্ষার্থী পারাপার হন এই রাস্তা দিয়ে। এরমধ্যে ছোট শিক্ষার্থীদের পারাপারের জন্য সবসময় রাস্তার ওপরে প্রস্তুত থাকেন আয়ূব আলী। আর এই কাজটি তিনি করেন একদম বিনা পারিশ্রমিকে এবং নিজ উদ্যোগে।

এ প্রসঙ্গে মিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামারুল আরেফিন বাংলানিউজকে বলেন, আয়ূব আলী আমলা যানজটমুক্ত রাখতে সারাদিন নিরলস কাজ করে যান। তবে তিনি সরকারি কোনো বেতন-ভাতা পান না। সবার সহযোগিতা নিয়েই তার দিনাতিপাত। আমি নিজেও বিভিন্ন সময় তাকে সাহায্য সহযোগিতা করি।

দুই ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে সংসার আয়ূব আলীর। বড় ছেলে তৈয়ব আলী ট্রাকের ড্রাইভার, ছোট ছেলে নায়েব আলী কাজ করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। কিশোর বয়সের শুরুতেই বাবা কাওছেদ আলীকে হারানোর পর ছোট দুই ভাই ও মাকে নিয়ে শুরু হয় উপজেলার ইশিলমারীর এই আয়ূব আলীর সংসার জীবন। কিছুদিন পর মাও চলে যান না ফেরার দেশে। দুই ভাইকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়া আয়ূব আলী তখন সংসার চালাতে কাজ শুরু করেন ভ্যানচালক হিসেবে।

মাথার ক্যাপটা নতুন করে পরে নিয়ে আয়ূব আলী বাংলানিউজকে বলেন, আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। তখন আমি ভ্যান চালাতাম। ভ্যান চালিয়ে দিনে গড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা আয় করতাম। একদিন মিরপুর থেকে ১০ কিলোমিটার ভ্যান চালিয়ে আমলা বাজারে ছয়জন যাত্রী নিয়ে আসলাম। মোট ভাড়া নয় টাকা। হঠাৎ দেখি আমলা বাজারে প্রচুর ভিড়। মানুষ চলাচল করতে পারছে না। রাস্তা জ্যাম হয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে, দেখলাম নাসির মোল্লা নামে একজন ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা গেছেন। এজন্য রাস্তা বন্ধ। সাধারণ মানুষের কষ্ট দেখে ভ্যানটা রাস্তার এক পাশে রেখে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে পড়লাম রাস্তায়। যানচলাচল স্বাভাবিক করলাম। সে থেকেই ভ্যান চালানোতে ইতি টেনে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আজ পর্যন্ত ৩০ বছরের মধ্যে ব্যস্ততম সড়কের এখানে কোনো সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার ছেলেমেয়ে বিভিন্ন স্কুলে যায়। তাদের রাস্তা পারাপারে কোনো অসুবিধা হয় না।

মানুষের ভালোবাসা বেশ উপভোগ করেন আয়ূব আলী।  ছবি: বাংলানিউজ

দিনে ১৫ থেকে ২০ টাকা উপার্জন করা আয়ূব আলী সেসময় প্রায় ২০ বছর এ কাজ করেই বড় করেছেন দুই ভাইকে। এরপর আমলার মেয়ে ‘শান্তি’কে বিয়ে করে আমলাতেই তিনি শুরু করেন নতুন জীবন। আয়ূব আলীর কণ্ঠে, জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। এখনও করছি। টাকা-পয়সা মানুষের থাকতে পারে। তবে মানুষের ভালোবাসা সবাই পায় না। আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। তাই তো পেশা আমার মানুষের উপকার করা।

তিনি বলেন, সে সময় আমলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর ভাই, সদরপুরের চেয়ারম্যান হক ভাই, আমাকে এই কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। সে থেকে এভাবেই চলছে। মাঝে-মধ্যে কোনো বাস-ট্রাকের হেলপার-ড্রাইভার আমার এ কাজের জন্য দুয়েক টাকা করে দেন। সমাজের যারা বিত্তবান মানুষ আছে, তারা আমার সংসার চালানোর জন্য মাঝে মধ্যে সাহায্য করেন। আমি বাচ্চাদের ভালোবাসি। ওরা যখন সকালে রাস্তা পার হয়, আমি তাদের হাত ধরে পার করে দিই। বাচ্চারা আমাকে দাদু বলে ডাকে। তখন খুব ভালো লাগে। সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমি মনে করি আমার জীবনটা ধন্য। এমন ভালোবাসা কজনা পায়!

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৬, ২০১৯
এইচএমএস/টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ