ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলেকে কাজ পাইয়ে দিতে...

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৫, ২০১৯
উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলেকে কাজ পাইয়ে দিতে...

যশোর: যশোরের কেশবপুর উপজেলা পরিষদ চত্বরের সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয় (সাবেক কোর্ট ভবন)। ১৯৮৪ সালে নির্মিত একতলা আদালত ভবনটিতে ছোট-বড় মিলিয়ে ২০টির মতো কক্ষ রয়েছে। উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তর ভবনটিকে ‘পরিত্যক্ত’ হিসেবে ঘোষণার পর এটি নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে তৈরি করা এস্টিমেটে উল্লেখ করা হয়, ভালো-মন্দ মিলিয়ে প্রায় ১ লাখ ইট, প্রায় ৭ হাজার কেজি রড, ৩৬টি সাটার ও গ্রিল রয়েছে ভবনটিতে। রয়েছে আনুষঙ্গিক মালামালও। 

আয়তনে বিশাল হলেও ‘পরিত্যক্ত’ ভবনটি নিলামে বিক্রির সর্বনিম্ন দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৮০ টাকা। আর সর্বনিম্ন দর গোপনীয় থাকার কথা থাকলেও রহস্যজনকভাবে এ দরের চেয়ে মাত্র ১ হাজার ৭২০ টাকা বেশি দিয়ে নিলাম বাগিয়ে নিয়েছেন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী রফিকুল ইসলামের ছেলে যুবলীগ নেতা কাজী মোজাহিদুল ইসলাম পান্না।

যদিও বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এই দরপত্রের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ৪৭ জন ঠিকাদার শিডিউল কিনেছিলেন। তবে টেন্ডার দাখিলের দিন আধিপত্য বিস্তারের কারণে শিডিউল জমা দেন মাত্র চারজন। এত অল্পদামে ভবনটি উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে পেয়ে যাওয়ায় এখন সংশ্লিষ্ট মহলে চলছে নানা আলোচনা। কিছু কিছু দফতরে অবশ্য অভিযোগও গেছে।

স্থানীয় ঠিকাদারদের অভিযোগ, পছন্দের ঠিকাদার পান্নাকে কাজটি পাইয়ে দিতেই নামমাত্র দর নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে টেন্ডারটি বাগিয়ে নিতে যশোর-খুলনা থেকে আসা ঠিকাদারদের শিডিউল জমা দিতে দেওয়া হয়নি। পান্নার লোকজন এবং প্রকৌশল অফিসের কর্মকর্তারা স্থানীয় ঠিকাদারদের নানাভাবে ফোন করে শিডিউল জমা দিতে নিষেধ করেন। পরে এই ‘টেন্ডার নাটকে’ পান্নার অনুসারীরা কমমূল্য দেখিয়ে দুইটি এবং তরিকুল ইসলাম নামের আরেক ঠিকাদার বেশি মূল্যে শিডিউল জমা দেন।  

খুলনা থেকে শিডিউল কেনা এক ঠিকাদার বাংলানিউজকে বলেন, টেন্ডারে অংশ নিয়ে পুরাতন ভবনটি ১০ লাখ টাকার বেশি দামে কিনতে ১ হাজার টাকা দিয়ে শিডিউল কিনেছিলাম। তবে জমা দেওয়ার শেষ দিনে উত্তপ্ত পরিস্থিতি দেখে উদ্বিগ্ন হয়েই জমা না দিয়ে ফিরে আসি।  

তিনি আরও বলেন, বিষয়টি তো স্পষ্ট যেখানে ৪৭ জন ঠিকাদারের মধ্যে জমা দিলো ৪ জন, তাও সরকারিভাবে নির্ধারিত দরের চেয়ে মাত্র কয়েক শত’ টাকা বেশি দরে। এখানে অফিসের যোগসাজশ না থাকলে কর্তৃপক্ষের গোপন দরটি উনি (কাজী মোজাহিদুল ইসলাম পান্না) জানলেন কীভাবে?সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয়।  ছবি: বাংলানিউজকেশবপুরের স্থানীয় একাধিক ঠিকাদার বাংলানিউজকে বলেন, টেন্ডারে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যেই শিডিউল কিনেছিলাম, কিন্তু জমা দেওয়ার শেষ দিন সকালে প্রকৌশল অফিসের সার্ভেয়ার মনিরসহ একাধিক কর্মকর্তা ফোন করে শিডিউল জমা না দেওয়ার কথা বলেন। এমনও বলা হয়, যেহেতু ভবনটা উপজেলা চেয়ারম্যান নিতে ইচ্ছে প্রকাশ করে নেগোসিয়েশন করেছেন, সেহেতু ঝামেলায় না যাওয়াটাই ভালো! 

এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, আমরা প্রকৌশল অধিদপ্তরের অন্য প্রকল্পের কাজও করছি, ফলে তাদের নির্দেশের বাইরে গিয়ে তো টিকে থাকা অসম্ভব।

অবশ্য ঠিকাদার তরিকুল ইসলাম দুদক ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ বিষয়ে অভিযোগও করেছেন। তিনি তার অভিযোগে উল্লেখ করেছেন, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করেও সব নিয়ম মেনে উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়ে শিডিউল জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রকাশ্যেই পান্নার সন্ত্রাসীরা টেন্ডার বাক্স থেকে আমার শিডিউলের সাথে জমা দেওয়া টাকা এবং কয়েকটি কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়। পরে টাকা নেই অভিযোগ দেখিয়ে আমার শিডিউল বাতিল করে পছন্দের ঠিকাদার পান্নাকেই কাজ দেওয়া হয়েছে। অথচ, তার চেয়ে বেশি দরদাতা হয়েও কাজটি আমি পেলাম না।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে কাজী মোজাহিদুল ইসলাম পান্না দরপত্র ছিনতাইয়ের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যানের ছেলে বলে আমি কোনো কাজ করতে পারবো না? নাকি এমন কোনো আইন হয়েছে?

কেশবপুর উপজেলা প্রকৌশলী মনছুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, নিলামে কোনো অনিয়ম হয়নি। সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে মোজাহিদুল ইসলাম পান্না কাজটি পাচ্ছেন। তরিকুল নির্ধারিত বাক্সে কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কোনো টাকা পাইনি এজন্য তার কাজ বাতিল হয়ে গেছে। দরপত্র ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা ঘটেনি।  

সর্বনিম্ন দর তুলনামূলক কম কি-না এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এসব ভবন সরাতে অনেক খরচ হয়, এছাড়া মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়েই সবকিছু করেছি।  

তবে ৪৭ জনের মধ্যে ৪ জনের দরপত্রে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা আমাদের জানার ব্যাপার নয়, একজন ঠিকাদার অংশ নিলেও সবকিছু ঠিক থাকলে তাকে কাজ দিতে আপত্তি কোথায়? তার চেয়ে বড় কথা, একটা পুরাতন ভবন সরিয়ে সেখানে নতুন উপজেলা পরিষদ হবে এটাই তো বড় ব্যাপার, এত সামান্য টাকা কি কেউ দুর্নীতি করে? এ ব্যাপারে দুদক থেকেও ইউএনও’র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, আপনি প্রয়োজনে তার (ইউএনও) সঙ্গে কথা বলতে পারেন।  

তবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিজানুর রহমানকে ফোন করা হলেও তিনি মিটিংয়ে থাকায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

যোগাযোগ করলে কেশবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, নিলাম প্রক্রিয়ায় আমার জানা মতে কোনো অনিয়ম হয়নি। আমার সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্য ওই ঠিকাদারকে (তরিকুল) দিয়ে কেউ অভিযোগ করাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১৯
ইউজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।