ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

লেছড়াগঞ্জে বেড়েই চলেছে বাল্যবিয়ে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৪, ২০১৯
লেছড়াগঞ্জে বেড়েই চলেছে বাল্যবিয়ে

মানিকগঞ্জ: অভাব ও পর্যাপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকায় লেছড়াগঞ্জে বেড়েই চলেছে বাল্যবিয়ের প্রবণতা। জেলা ও উপজেলা সদরের সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ায় চরাঞ্চলের বাল্যবিয়ের ঘটনা দিনদিন বেড়েই চলেছে।

জানা যায়,  বিয়ের জন্য সরকারি নিয়ম অনুসারে ১৮ বছর বয়স নির্ধারণ করা হলেও জাল জন্মসনদ ও কোর্টের ভুয়া হলফনামার মাধ্যমে বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়েই চলছে লেছড়াগঞ্জ চরাঞ্চলে। সরকারিভাবে বাল্যবিয়ে রোধে চাপ থাকায় অনেক অভিবাবকরা ছেলে-মেয়েকে এ সব উপায়ে বিয়ের কার্যক্রম চালাচ্ছেন।

লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের নটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিবছর যতো ছাত্রী ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হচ্ছে এসএসসি পর্যন্ত যেতে তাদের প্রায় অর্ধেকর বেশিই ঝরে যাচ্ছে। এর প্রধানত কারণ হচ্ছে বাল্যবিয়ে। এখানে ঝরে যাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের বিয়ে হয়ে গেছে এমন তথ্য পাওয়া যায় বিদ্যালয় থেকে। অষ্টম থেকে নবম শ্রেণির মধ্যেই বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি।  

শিক্ষকদের ধারণা, ঝরে যাওয়া ৫০ জনের মধ্যে হয়তো দু-তিন জন ছাড়া সবাই বাল্য বিবাহের শিকার। এতো অল্প বয়সে বিয়ের কারণে চরাঞ্চলের তালাকের প্রবনতাও বেশি আর এ তালাকে মূল কারণ সংসার জীবনে মানিয়ে নিতে অনেক সময় নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় অল্প বয়সে বিয়ে হওয়া মেয়েদের। এছাড়া বয়সের চেয়ে দ্বিগুন বা তারও বেশি বয়সের ছেলেদের (স্বামী) সঙ্গে বিয়ে হয় তাদের।

চরাঞ্চলের মানুষের ধারণা, কম বয়সের মেয়েদের বিয়ের বাজারে চাহিদা ভাল। বয়স বাড়ালে নাকি পাত্রদের তেমন আগ্রহ থাকে না। দারিদ্র্যের কারণে মেয়ে বিয়ে দিয়ে হালকা বোধ করেন অনেক অভিবাবকরা। এছাড়া দেখতে সুন্দর হলে বখাটের উৎপাত, আবার প্রেমে পড়ে মেয়েদের ঘর ছেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা এসবই বাল্য বিবাহের প্রধান কারণ বলে মনে করেন অনেকেই।

নটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির বাণিজ্য বিভাগের ছাত্রী রুপালী আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের সঙ্গে অনেক বান্ধবী পড়ালেখা করতো। অষ্টম শ্রেণিতে এক সঙ্গে ৭০ জন জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলাম আর এখন দশম শ্রেণিতে আমরা ২২ জন লেখাপড়া করছি। অধিকাংশ বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি নিজেও অনেক সময় ভয় পাই যে আমার কখন যেন পরিবার থেকে বিয়ে দিয়ে দেয়। আমার স্বপ্ন আমি পড়ালেখা করে এই লেছড়াগঞ্জ চরাঞ্চলের শিক্ষকতা করবো এবং এই বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করবো।

এই একই শ্রেণিতে পড়ুয়া মানবিক বিভাগের আরেক এক ছাত্রী কেয়া আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাড়ির কাছে কয়েকদিন আগে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক স্কুলছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। মেয়েটা পড়ালেখায় অনেক ভাল ছিল। শুধু অভাবের কারণে ওকে ওর বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। ওর বিয়ে দেখে আমার অনেক ভয় করছে। যদি ওর মতো আমারও বিয়ে হয়।

নটাখোলা এলাকার ছবেদ আলী ব্যাপারী বাংলানিউজকে বলেন, কাঁচা বয়সে মাইয়া বিয়া না দিলে পরে আর বিয়া অইবোনা। টান থাকতে বিয়া দিতে অইবো। মাইয়াগো পড়ালেহা করাইয়া কি জজ ব্যারেস্টার বানাইবার পারমুনা, তাইলে এতো পড়াইয়া লাভ কী?

নটাখোলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বাংলানিউজকে বলেন, লেছড়াগঞ্জ চরাঞ্চলের মানুষ নানাদিক দিয়ে অবহেলিত। এখানে বসবাসকারী মানুষের ভেতর শিক্ষার আলো না থাকায় বাল্যবিয়ের হার অনেকটাই বেশি। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠতেই অধিকাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে যায়। আমরা মেয়েদের বাবা-মায়েদের অনেক সময় বোঝাবার চেষ্টা করলে তারা বলে টান থাকতে মেয়ে বিয়ে দিতে হয় নইলে পরে বোঝায় পরিণত হয়। এছাড়া আরও একটি বড় সমস্যা হলো চরাঞ্চলের অধিকাংশ জেলে ও কৃষকের বসবাস, অভাবের তাড়নায় অনেকে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়।

লেছড়াগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ মেহেদি হাসান সোনা মিয়া বাংলানিউজকে বলেন, মাঝে মাঝেই আমার কাছে অনেকে বয়স বাড়িয়ে জন্মসনদ নিতে আসে, না দেওয়াতে অনেকে আবার কোর্টে গিয়ে হলফনামার মাধ্যমে বয়স বাড়িয়ে নিয়ে এসে বিয়ের কার্যক্রম করেন। আসলে এটা তো সম্পূর্ণভাবে অবৈধ, একথা বলতে গেলে তারা নানা কথা বলে। বয়স বাড়লে নাকি বিয়ে হবে না, তখন মেয়ে বাবার মাথার বোঝা হয়ে থাকে। এছাড়া বখাটেপনার কারণেও অনেক সময় অভিবাবকরা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে থাকেন ।

মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক এসএম ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, লেছড়াগঞ্জ দুর্গম চরাঞ্চল হওয়াতে বাল্যবিয়ে রোধের প্রচারণা হয়তো কিছুটা কম, যে কারণে এ সমস্যা দেখা দিয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।