ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ফতুল্লার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আদ্যোপান্ত

মাহফুজুর রহমান পারভেজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
ফতুল্লার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আদ্যোপান্ত ফতুল্লার জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আদ্যোপান্ত

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটসহ বিভিন্ন ইউনিট। বাড়িটিকে নব্য জেএমবির সদস্যরা বোমা তৈরির ল্যাব হিসেবে ব্যবহার করতো বলে জানা গেছে। তবে, সেখানে কেউ থাকতো না। বাড়িটি থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম, আইডি, বিস্ফোরক তৈরির উপাদান, খেলনা পিস্তল, চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) ভোরে শুরু হওয়া অভিযান সম্পন্ন হয় দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে। ফতুল্লার পিলকুনী তক্কারমাঠ এলাকার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক উপ মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জয়নাল আবেদিনের বাড়িটিতে অভিযানটি পরিচালিত হয়।

অভিযানের আগে ভোরে তার দু’ছেলে ফরিদউদ্দিন রুমি ও জামালউদ্দিন রফিক এবং ফরিদউদ্দিনের স্ত্রী অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা জান্নাতুল ফোয়ারা ওরফে অনুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। যদিও রুমি ও তার স্ত্রীর পরিচয় শনাক্ত করে তাদের আটকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তবে, ঢাকা থেকে আরেকজনকে আটক করা হয়েছে ও তার পরিচয় নিশ্চিত নয় বলেও জানান তিনি। অভিযানে পুলিশ সদস্যরা।  ছবি: বাংলানিউজযেভাবে আটক হলেন তিন নব্য জেএমবি সদস্য: কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একটি দল রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) দিনগত রাতে ঢাকা থেকে যন্ত্রকৌশলী জামালউদ্দিন রফিককে (২৩) আটক করে। পরে তার দেওয়া তথ্য মতে ফতুল্লার দাপার একটি বাড়ি থেকে তার বড় ভাই আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ফরিদউদ্দিন রুমিকে (২৭) আটক করা হয়।

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন আটকরা সবাই নব্য জেএমবি সদস্য। তাদের বেশ কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। তাদের ধরতে চেষ্টা চলছে।  

যেভাবে শুরু অভিযান: দীর্ঘ তিনমাস ধরে নজরদারির পর নব্য জেএমবির সদস্য রুমিকে আটকের পর তার দেওয়া তথ্য মতে বাড়িটিতে ভোর থেকেই অভিযান শুরু করে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট ও জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা। যে বাড়িটি ঘেরাও করা হয়েছে, মাঝেমধ্যে সেখানে এসে থাকতেন তিনি। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ভোরেই সেখানে পৌঁছায়।

সকালে প্রথমেই বাড়িটিকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখে আশ-পাশের বাড়িগুলো থেকে মানুষদের সরিয়ে দেওয়া হয়। সকাল ১০টার মধ্যেই বাড়িটির আশ-পাশের ১৭ থেকে ২০টি ঘর খালি করে ফেলা হয়। পরে জেলা পুলিশ, জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ, পুলিশের সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট, পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, পিবিআই, পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ গাড়ি ও যন্ত্রপাতি, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, ট্রাফিক বিভাগসহ বিভিন্ন ইউনিট পুলিশের সদস্যরা এখানে উপস্থিত হন। বাড়িতে পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। শুরু হয় বোমা শনাক্তকরণ ও নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া। পরবর্তীকে পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মনিরুল, পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আসাদুজ্জামান, জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলামসহ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে শুরু হয় অভিযান।

কী ছিল বাড়িটিতে: অভিযান শুরুর সময় উপস্থিত পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, বাড়িটিতে প্রবেশ করার পর সেখানে শক্তিশালী কয়েকটি বোমা, বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম, আইডি, বিস্ফোরক তৈরির উপাদান, খেলনা পিস্তল, চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দেখা যায়। এখানে মূলত বোমা তৈরির ল্যাব হিসেবেই কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো।

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল বলেন, অভিযানে বাড়িটিতে বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, এ বিস্ফোরক দিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ২০টি বোমা (আইইডি) তৈরি করা যেতো।

কারা থাকতো ওই বাড়িতে: মূলত বাড়িটিতে তেমন কেউই থাকতো না বলে আশ-পাশের বাসিন্দাদের থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। তবে মাঝেমধ্যে রুমিকে আসা যাওয়া করতে দেখেছেন অনেকেই। এছাড়া তার (জয়নাল আবেদিন) ছেলেদের এলাকায় তেমন কেউ চিনতোও না। আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ফরিদউদ্দিন রুমিকে মূলত দাপার একটি বাড়িতে থাকতেন এবং সেখান থেকেই তাকে আর তার স্ত্রীকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া বাড়িতে আর তেমন কারো আসা যাওয়া ছিল না বলেই জানায় এলাকাবাসী।  পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। শিক্ষিত পরিবারের সন্তান থেকে জঙ্গি কার্যক্রমে: যে বাড়িটিতে অভিযান পরিচালিত হয়েছে ওই বাড়ির মালিক জয়নাল আবেদিন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন কর্মকর্তা। আর যাকে নব্য জেএমবি হিসেবে আটক করা হয়েছে তিনি হলেন আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের শিক্ষক ফরিদউদ্দিন রুমি। রুমির স্ত্রী জান্নাতুল ফোয়ারা ওরফে অনুও অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা। একেবারেই উচ্চ শিক্ষিত ও সমাজের শিক্ষিত শ্রেণীর লোক হিসেবেই পরিচিত তারা। সেই শিক্ষিত শ্রেণী থেকে কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন জঙ্গি কার্যক্রমে সেটি নিয়েই এখন তদন্ত করছে পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট। ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামসহ অন্যরা। ঢাকা থেকে কাছের দূরত্বেই নারায়ণগঞ্জকে পছন্দ জঙ্গিদের: মূলত যে স্থানে বাড়িটি সেখান থেকে তিনটি পথ ব্যবহার করে ঢাকায় খুব অল্প সময়েই যাওয়া যায়। বাড়িটির পশ্চিম দিকের সড়ক দিয়ে সরাসরি পাগলা হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করা যায়, উত্তর দিকে দাপা হয়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ পুরাতন সড়ক ব্যবহার করে ঢাকায় প্রবেশ করা যায় এবং পূর্ব দিকে ফতুল্লা স্টেডিয়াম দিয়ে বের হয়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড ব্যবহার করে ঢাকামুখী হওয়া যায়। খুব সহজেই ঢাকায় প্রবেশে একাধিক পথ ব্যবহার করা যায় বলেই নারায়ণগঞ্জকে পছন্দের তালিকায় রাখেন জঙ্গিরা।

বোমা বিস্ফোরণ ও নিষ্ক্রিয়করণ: এর আগে বোমা নিষ্ক্রিয়করণ বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা বাড়িটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর চারটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দুপুর ১২টা ৫৭মিনিটে, ১টা ১০ মিনিটে, ১টা ২৪মিনিটে ও ২টা ৯মিনিটে সর্বশেষ বোমা বিস্ফোরণের আওয়াজগুলো শোনা যায়। শেষ বিস্ফোরণের পর অভিযানস্থলে আগুন ধরে গেলে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। ঘটনাস্থলে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট: পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট, জেলা পুলিশ, জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি), পুলিশের সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট, পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, পিবিআই, পুলিশের সিটিটিসি ইউনিট, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ গাড়ি ও যন্ত্রপাতি, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স, ট্রাফিক বিভাগসহ বিভিন্ন ইউনিট পুলিশের সদস্যরা এখানে অভিযানটিকে সহায়তা ও কাজ করেছে। সবাই সম্মিলিত সহযোগিতায় কোনো ধরনের হতাহত ছাড়াই অভিযানটি সম্পন্ন ও বোমাগুলো বিস্ফোরণের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় করার কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

তাদের টার্গেট ছিল পুলিশের নিরস্ত্র সদস্যরা: মূলত নব্য জেএমবির সদস্যদের টার্গেট ছিল পুলিশের নিরস্ত্র সদস্য যেমন ট্রাফিক পুলিশ, পুলিশ বক্স এমনটাই জানিয়েছেন পুলিশের সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম।

তিনি জানান, তারা মূলত পুলিশের ওপর হামলা করে তাদের মনোবল ভেঙে দেওয়া, তাদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্যই এ ধরনের হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাদের কাছে যে পরিমাণ সরঞ্জাম রয়েছে তার মধ্যে খেলনা পিস্তল ও বোমা তৈরির সরঞ্জামগুলোর বিষয় আমরা খতিয়ে দেখছি। এছাড়াও তাদের আরও নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। উদ্ধার হওয়া বিস্ফোরকদ্রব্য। নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিম নিহত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে: নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় একটি বাসায় আস্তানা ছিল নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড তামিমের। ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয় নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের নেতৃত্বে পরিচালিত ওই অভিযানে নিহত হয় নব্য জেএমবির মাস্টারমাইন্ড বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরী। এ সময় তামিমের সঙ্গে মারা যায় তার আরও দু’সহযোগী। তাদের একজন ধানমন্ডির তওসিফ হোসেন ও যশোরের ফজলে রাব্বী। তামিম হলি আর্টিজানসহ বিভিন্ন জঙ্গি হামলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে খ্যাত ছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
এএটি

আরও পড়ুন...

***ফতুল্লায় আটকরা নব্য জেএমবির, সাম্প্রতিক হামলায় সম্পৃক্ত

***ফতুল্লার ঘিরে রাখা বাড়িতে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট

***ফতুল্লায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিশ

***ফতুল্লার ‘জঙ্গি আস্তানায়’ বিস্ফোরক পাওয়া গেছে: মনিরুল

***বোমা তৈরির ল্যাব ছিল ফতুল্লার ‘জঙ্গি আস্তানায়’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad
welcome-ad