ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

তালপাতার পাখায় ঘোরে সামাদের সংসারের চাকা

মো. রাজীব সরকার, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯
তালপাতার পাখায় ঘোরে সামাদের সংসারের চাকা পাখা বানাচ্ছেন আব্দুল সামাদ শেখ। ছবি: বাংলানিউজ

গাজীপুর: গরম পড়তেই মনে পড়ে তার কথা। কারণ গরম তাড়াতে যার জুড়ি মেলা ভার। তার মানে শহর-গ্রামের চিরাচরিত তালপাতার হাত পাখার। এ তালপাতার পাখা বানিয়ে সংসারের চাকা ঘুরান গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মারর্তা বাঘমারা এলাকার আব্দুল সামাদ শেখ (৬৫)। 

যাদের বৈদ্যুতিক পাখার সুবিধা নেই, তাদের কাছে তালপাতার পাখা আজও পরম আদরনীয়। দেশজুড়ে চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে মেলায় রঙবেরঙের তালপাতার পাখা বিক্রি করতে দেখা যায়।

তালপাতার সব ধরনের পাখা বানান আব্দুল সামাদ শেখ ও তার স্ত্রী মোমেনা বেগম (৫৫)। তালপাতার পাখা তৈরি করে সংসারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন তারা দু'জন। এখন তার দু'ছেলেও তাদের স্ত্রীদের নিয়ে তালপাতার পাখা তৈরি করেন। আর তালপাতার পাখা বিক্রি করেই চলে তাদেরও সংসার।  

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আব্দুল সামাদ শেখ তার বাড়ির বারান্দায় বসে তালপাতা পাখা তৈরি করছেন। বাড়ির ভেতর তার দু' ছেলে ও পুত্রবধূরা বারান্দায় বসে তালপাতার পাখা তৈরিতে ব্যাস্ত সময় পার করছেন।

তালপাতার পাখার শুকানো হচ্ছে।  ছবি: বাংলানিউজদেখে মনে হয় তার বাড়িতে তালপাতার পাখা তৈরির উৎসব লেগেছে। আব্দুল সামাদ শেখ তার বাড়ির পাশে কার্পেটি একটি সড়কের পাশে সারিবন্ধভাবে শুকাতে দিয়েছে তালপাতা ও পাখা। ঘরের বারান্দা ও উঠানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শুধু তালপাতার পাখা। আব্দুল সামাদ শেখের স্ত্রী মোমেনা বেগম বেশ কিছু তালপাতার পাখা গুছিয়ে নিয়েছে বিক্রি করতে বাজারে যাচ্ছে।  

আব্দুল সামাদ শেখের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, শ্রীপুর উপজেলার মারর্তা বাঘমারা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল সামাদ শেখ। ৩ সন্তানের জনক তিনি। ৩৫ বছর আগে তিনি বিভিন্ন ফল বিক্রি ও বিভিন্ন কাজ করতেন। এতে সংসার চালাতে হিমশিম খেতো হতো আব্দুল সামাদ শেখকে। পরে এলাকার অন্য লোকদের দেখাদেখি তিনি বেছে নিলেন তালপাতার পাখা তৈরির কাজ। সেই থেকে শুরু। গত ৩৫ বছর ধরে তিনি তৈরি করে আসছেন তালপাতার হাত পাখা। পাশাপাশি তার স্ত্রী মোমেনা বেগমও তৈরি করেন হাত পাখা। আর সেগুলো বিক্রি করে সচ্ছলভাবেই চলছে তাদের সংসার। মোমেনা বেগম চাহিদা অনুযায়ী কাপড়ের পাখাও তৈরি করেন। তাদের এক ছেলে লেগুনা চালায় এবং দু' ছেলে ও পুত্রবধূরাও শিখেছেন তালপাতার পাখা তৈরির কাজ। তাদের সংসারও চলে তালপাতার পাখার ওপর ভর করে। সৎভাবে উপার্জন করে ভালোই চলছে আব্দুল সামাদ শেখের পরিবার। ওই এলাকায় আব্দুল সামাদ শেখ এবং ২ থেকে ৩ বাড়ি ছাড়া বর্তমানে আর কেউ পাখা তৈরি করেন না। আব্দুল সামাদ শেখের বাড়িতেই বেশি তৈরি হচ্ছে তালপাতার পাখা।  

পাখা বানাচ্ছেন আব্দুল সামাদ শেখের পুত্রবধূ।  ছবি: বাংলানিউজময়মনসিংহের ভালুকা থেকে ৫ টাকা পিস তালপাতা কিনে আনেন আব্দুল সামাদ শেখ। পরে লোহার এক ধরনের বিশেষ ধারালো দা দিয়ে গোল করে তালপাতা কেটে অতিরিক্ত অংশ ফেলে দেওয়া হয়। এরপর কাপড়, বাঁশ ও সুতা ব্যবহার করে তালপাতার হাত পাখা তৈরি করা হয়। ইচ্ছে মতো রঙ করে সৌন্দর্য বাড়ানো হয় তালপাতার পাখার। একটি তালপাতার পাখা বানাতে খরচ হয় সবমিলিয়ে প্রায় সাত টাকা। পাইকারি বিক্রি করেন প্রতিটি তালপাতার পাখা ২০ টাকা পিস। এতে একটি তালপাতার পাখায় লাভ থাকে ১২ থেকে ১৩ টাকা। প্রতিদিন আব্দুল সামদ শেখ একাই প্রায় ৫০টি পাখা তৈরি করেন। তার স্ত্রীও তৈরি করেন প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি পাখা। আব্দুল সামাদ শেখের তালপাতার পাখা গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও ঢাকা থেকে পাইকাররা এসে তার বাড়ি থেকে তালপাতার পাখা কিনে নিয়ে যায়।  

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল কাদির জানান, গরম পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুধু গ্রামবাংলায় নয় শহরেও চাহিদা থাকে তালপাতার পাখার। আগের তুলনায় সেই চাহিদা ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় এখন তালপাতার পাখার চাহিদা কমে গেছে। সেই কারণেই এখন তেমন পাখা তৈরির কারিগরদের দেখা যায় না। তবে, এ শিল্প আমাদের ধরে রাখা খুব প্রয়োজন।  

বিক্রির জন্য রাখা তালপাতার পাখা।  ছবি: বাংলানিউজআব্দুল সামাদ শেখ বলেন, তালপাতার পাখা তৈরি করে সংসারের চাকা ঘুরান তিনি। ছেলেরা সব আলাদা। তারাও পাখা তৈরি করে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে সংসার সাজিয়েছে। তালপাতার পাখা তৈরিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না বলে এ বয়সে এই কাজ করতে পারছি। পাখা বিক্রি করে সংসার ভালোই চলছে। তালপাতার পাখা তৈরি, এটা একটা শিল্প।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় এবং কালের বিবর্তনে এ শিল্পটি দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে। শুধু সংসার চালানো জন্য না, এ শিল্পটি ধরে রাখতেও তিনি এখনো তালপাতার পাখা তৈরি করছেন বলে জানান। এ এলাকায় আগে আরও অনেকেই তালপাতার পাখা তৈরি করতেন। এখন তারা অন্য কাজ করেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৯ 
আরএস/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad