ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

প্রকল্প বাগিয়ে ধাপে ধাপে ব্যয় বাড়াতেন ‘টেন্ডার শামীম’

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯
প্রকল্প বাগিয়ে ধাপে ধাপে ব্যয় বাড়াতেন ‘টেন্ডার শামীম’

ঢাকা: চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, মাদক ও অর্থসহ গ্রেফতার যুবলীগ নেতা পরিচয়ধারী এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জি কে বিল্ডার্স। এ প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রকল্প যাওয়া মানেই ধাপে ধাপে ব্যয় বৃদ্ধি। এমনকি প্রকল্পের কাজ কমিয়ে দেওয়ার পরও ব্যয় বাড়ানোর নজির গড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শামীমকে গ্রেফতার করার পর সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও পর্যায়ে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

গত ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে নিজের কার্যালয় ভবন থেকে ‘সুনির্দিষ্ট চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির অভিযোগে’ শামীমকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তার কার্যালয়ের ভেতর থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, মাদক, নগদ অর্থ ও ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর চেক উদ্ধার করা হয়।

জি কে শামীম নিজেকে এতদিন যুবলীগের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক পরিচয় দিয়ে এলেও তিনি গ্রেফতার হওয়ার পর সংগঠনটি তা অস্বীকার করেছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর ও কার্যালয়ে কথা বলে জানা যায়, জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানের হাতে ‘জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) সম্প্রসারণ’ প্রকল্পের আওতায় নবনির্মিত হাসপাতাল ভবন ও ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের মতো বড় বড় ১৭ প্রকল্প ছিল। তার প্রতিষ্ঠানের বাগিয়ে নেওয়া বেশিরভাগ প্রকল্পেরই ব্যয় ও সময় বাড়তো অবিশ্বাস্যভাবে। তারপরও গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে অধিকাংশ প্রকল্প বাগিয়ে নিতেন জি কে শামীম।  
 
সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের ২৪ নভেম্বর একনেক বৈঠকে সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আওতায় ১৪১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ২০তলা বিশিষ্ট রাজস্ব বোর্ড ভবন নির্মাণ করার কথা ছিল। পরে ভবন ১২ তলা করার সিদ্ধান্ত হলেও জি কে বিল্ডার্স প্রকল্পে ব্যয় বাড়িয়ে করে ৪৯৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ কমলেও ব্যয় বেড়ে যায় ৩৫৪ কোটি টাকা।
 
একইভাবে ২০১৩ সালে শুরু হওয়া ‘জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ায় জি কে বিল্ডার্স। প্রকল্পটি শুরুর সময় ৩৩৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হলেও শেষ হয় ৫০০ কোটি টাকায়।
 
২০১৮ সালে শুরু হয় ‘র‌্যাব ফোর্সেস সদরদপ্তর নির্মাণ’ প্রকল্পের আওতায় ‘কনস্ট্রাকশন অব র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স কমপ্লেক্স আশকোনা, উত্তরা, ঢাকা’ শীর্ষক প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯৫ কোটি ১০ লাখ টাকা। ২০২১ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় এই প্রকল্পেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কায় সংশ্লিষ্টরা।
 
আগারগাঁওয়ে ‘বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন কমপ্লেক্স নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্ব)’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়িত হয়। প্রকল্প গৃহীত হওয়ার সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৫ কোটি ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। জি কে বিল্ডার্স কাজ শেষ করে ২৪ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। প্রকল্পটি শেষ হওয়ার প্রায় একবছর পর পরিদর্শনে যায় সরকারের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। তারা দেখতে পায় নানা অনিয়ম ও ত্রুটির চিত্র। পরিদর্শনে আইএমইডির দায়িত্বশীলরা দেখেন, বেশ কিছু রুমের দরজায় ব্যবহৃত রিম/রাউন্ড, ডোর লক দেওয়া হয়েছে নিম্নমানের। এছাড়া সাউন্ডপ্রুফ প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় কর্মকমিশন সদস্যদের কক্ষে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা চলাকালে পাশে ব্যক্তিগত কর্মকর্তার কক্ষে অপেক্ষমান পরীক্ষার্থীরা সব প্রশ্ন শুনতে পারেন। ফলে গোপনীয়তার জায়গাটি নষ্ট হয়।

সংশ্লিষ্টরা তখন বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ভবনটি দায়সারাভাবে নির্মাণ করেছে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
 
জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান আরও বাগিয়ে নেয় অাগারগাঁওয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের দু’টি ভবন সম্প্রসারণ, মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনে সরকারি কোয়ার্টার নির্মাণ, মহাখালী গ্যাস্ট্রোলিভার, অ্যাজমা, ক্যান্সার ও সেবা মহাবিদ্যালয় নির্মাণ প্রকল্পের কাজও। বেইলি রোডে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমপ্লেক্সও শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জি কে বিল্ডার্স কাজ করেছে। অাগারগাঁও এলাকায় নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল, বিজ্ঞান জাদুঘর ও এনজিও ফাউন্ডেশনও নির্মাণ করছে শামীমের প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্স।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন-১) আখতার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমি যখন ছিলাম তখন তিনি (জি কে শামীম) কাজ পাননি। আমি চলে যাওয়ার পরে পেয়েছেন। এছাড়াও ইজিপিতে (ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্ট) টেন্ডার হতো। সেসময় কাকে ‘ম্যানেজ’ করে কাজ পেতেন আমার ধারণা নেই।
 
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প নিয়ে কাজ করেন যুগ্ম-প্রধান (পরিকল্পনা কোষ) সাজ্জাদুল ইসলাম। মেসার্স জি কে বিল্ডার্সের অধিকাংশ প্রকল্পের কাজ পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, মন্ত্রণালয় টেন্ডার কল করে না। টেন্ডার কল করে গণপূর্ত অধিদপ্তর-পিডব্লিউডি। প্রকল্পের প্রকিউরমেন্ট (পিডি) ওখানে হয়ে থাকে। ওখানে কীভাবে প্রভাব খাটিয়ে প্রকল্প তার প্রতিষ্ঠান (জি কে বিল্ডার্স) কাজ পায় পিডব্লিউডি ভালো বলতে পারবে।
 
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলেও গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি) প্রধান প্রকৌশলী সাহাদাত হোসেনকে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে কয়েকবার ফোন করা হলেও কথা বলা যায়নি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন হায়দারের সঙ্গে।
 
শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জি কে বিল্ডার্সের সুপারভাইজার মোহাম্মদ রিপন বাংলানিউজকে বলেন, ভাই (শামীম) বর্তমানে সব মিলিয়ে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কাজ করছেন। ভাই কাজে ফাঁকি দেন না। সব কাজ মানসম্মতভাবে করেন বলেই ভাই কাজ পান। ভাইয়ের কোম্পানিতে লেবারই অাছে ৪-৫ হাজার। ভাইয়ের সকল কাজ নিট অ্যান্ড ক্লিন।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৯ 
এমআইএস/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad