ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

মিন্নির জবানবন্দিতে ‘অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা’

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯
মিন্নির জবানবন্দিতে ‘অবিশ্বাস্য নাটকীয়তা’

বরগুনা: আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় দাখিল করা সর্বমোট ৬১৪ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) আদালত গ্রহণ করেছেন। এ হত্যা মামলায় সাক্ষী থেকে ৭ নম্বর আসামি হওয়া আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফ হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেলেন।

আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রের আলোকে তা তুলে ধরা হলো-

আমি বরগুনা সরকারি কলেজে ডিগ্রি ১ম বর্ষে পড়ালেখা করি। ২০১৮ সালে বরগুনা আইডিয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি।

আইডিয়াল কলেজে পড়াশোনা করা কালীন ২০১৭ সালে আমার প্রেমের সম্পর্ক হয়। ওই সময় রিফাত শরীফ বামনা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিলো। রিফাত শরীফ ও নয়ন বন্ড পরস্পর বন্ধু ছিলো। রিফাত শরীফ আমাকে তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, নয়ন বন্ড তার মধ্যে একজন।

কলেজে যাওয়া আসার পথে নয়ন বন্ড আমাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে জ্বালাতন করতো। আমি তার প্রেমের প্রস্তাবে সায় না দেওয়ায় সে আমার বাবা ও ছোট ভাইকে ক্ষতি করার ভয় দেখাতো। বিষয়টি আমি রিফাত শরীফকে জানাই নাই। আমি রিফাত শরীফকে ভালোবাসতাম, কিন্তু রিফাত শরীফ অন্য মেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক করার কিছু বিষয় আমি লক্ষ্য করি এবং এ কারণে রিফাতের সঙ্গে আমার সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটে এবং আমি ধীরে ধীরে নয়ন বন্ডের দিকে ঝুকে পড়ি এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি নয়নের মোবাইল নম্বরে আমার মায়ের মোবাইল নম্বর (০১৭১৯৬৩৩৭৩৩) এবং নয়নের দেওয়া নম্বর শেষে ৬১১৩ ও অন্য একটি নাম্বার শেষে ৪৫ দিয়ে নয়নকে কল, ম্যাসেজ পাঠাতাম এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে কল দিতাম।

বরগুনা সরকারি কলেজে পড়াশোনাকালীন ধীরে ধীরে রিফাত ফরাজী, রিফাত হাওলাদার ও রাব্বি আকনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। রিফাত ফরাজী ও নয়ন বন্ডের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। প্রেমের সম্পর্কের কারণে নয়ন বন্ডের বাসায় আমার যাতায়াত ছিলো। নয়নের বাসায় দু’জনের শারীরিক সম্পর্কের কিছু ছবি-ভিডিও নয়ন গোপনে ধারণ করে। যা আমি প্রথমে জানতাম না। নয়নের বাসায় আমি প্রায়ই যেতাম এবং আমাদের শারীরিক সম্পর্ক চলতে থাকে। এরপর গত ১৫/১০/১৮ তারিখ আমি রোজী আন্টির বাসায় যাওয়ার পথে বিকেল বেলা ব্যাংক কলোনী থেকে নয়ন বন্ড রিকশায় করে আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। নয়নের বাসায় গিয়ে আমি শাওন, বাবু, রিফাত ফরাজী এবং আরও ৭/৮ জনকে দেখি। শাওন বাইরে গিয়ে কাজী ডেকে আনে এবং নয়নের বাসায় আমার ও নয়নের বিয়ে হয়। তারপর আমি বাসায় চলে যাই। বাসায় গিয়ে নয়নকে ফোন করে বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখতে বলি। তখন নয়ন বলে এটা বালামে ওঠে নাই, বালামে না উঠলে বিয়ে হয় না। এরপরও আমি নয়নের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখি। নয়নের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি আমার পরিবারের কেউ জানে না।

২০১৯ সালের শুরুর দিকে কলেজ থেকে পিকনিকে কুয়াকাটা যাওয়ার বাস আমি মিস করি। তখন নয়নের মোটোরসাইকেলে আমি কুয়াকাটা যাই এবং নয়নের সঙ্গে একটি হোটেলে রাত্রিযাপন করি। আমি নয়নের বাসায় আসা যাওয়া কালে আস্তে আস্তে জানতে পারি নয়ন মাদকসেবী, ছিনতাই করে এবং তার নামে থানায় অনেক মামলা আছে। এ কারণে নয়নের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অবনতি হয় এবং রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার পূর্বের ভালোবাসার সম্পর্ক আবার শুরু হয়।

গত ২৬/৪/১৯ তারিখ পারিবারিকভাবে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। রিফাত শরীফের সঙ্গে বিয়ের পরও নয়নের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ, শারীরিক সম্পর্ক, মোবাইলে কথাবার্তা, ম্যাসেজ, ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ সবই চলতো।
বিয়ের পর জানতে পারি রিফাত শরীফ মাদকসেবী, সে মাদকসহ পুলিশের নিকট ধরা খায়। বিষয়টি জানতে পেরে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমি রিফাতসহ আমার বাবার বাসায় থাকতাম। মাঝে মাঝে তাদের বাসায় যেতাম। নয়ন বন্ডের বিষয় নিয়ে রিফাত শরীফের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হতো এবং রিফাত শরীফ আমার গায়ে হাত তুলতো।

গত ২৪/৬/১৯ তারিখ দুপুর ১২.৩০টার দিকে নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দিয়ে বলে যে, তোর স্বামী হেলালের ফোন ছিনিয়ে নিয়েছে। পরে রিফাত ফরাজীও আমাকে ফোন দিয়ে বলে হেলালের মোবাইলটি রিফাতের কাছ থেকে নিয়ে ফেরত দিতে। আমি রিফাত শরীফকে হেলালের ফোন ফেরত দিতে বললে রিফাত শরীফ আমাকে চড়-থাপ্পড় মারে এবং তলপেটে লাথি মারে। রাতে মোবাইল ফোনে নয়নকে জানাই এবং কান্না করি। এরপর ২৫/৬/১৯ তারিখ আমি কলেজে গিয়ে নয়নের বাসায় যাই। ‘রিফাত শরীফকে একটা শিক্ষা দিতে হবে’ একথা নয়নকে বললে সে বলে হেলালের ফোন নিয়ে যে ঘটনা তাতে রিফাত ফরাজীও তাকে মারবে। তারপর আমি বাসায় চলে আসি এবং রাতে এ বিষয়ে কয়েকবার আমার নয়ন বন্ডের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয় এবং নয়ন বন্ডের সঙ্গে আমার স্বামী রিফাত শরীফকে মাইর দিয়া শিক্ষা দিতে হবে- এই পরিকল্পনা করি।

২৬/৬/১৯ তারিখ সকালে আমি কলেজে যাই এবং সায়েন্স বিল্ডিংয়ের পাশে বেঞ্চের উপর রিফাত ফরাজী ও রাব্বি আকনকে বসা পাই। রিফাত হাওলাদার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন আমি রিফাত ফরাজীর পাশে বসি এবং তাকে বলি ‘ওকি ভাইডু, খালি হাতে আসছো কেন’ এ কথার জবাবে রিফাত হাওলাদার বলে ‘ওকে মারার জন্য খালি হাত যথেষ্ট’। এরপর রিফাত ফরাজীকে জিজ্ঞাসা করি নয়ন বন্ড ও রিফাত শরীফ কলেজে এসেছে কিনা। তখন নয়ন বন্ড আমাকে ফোন দেয়। আমি সে কোথায় জানতে চাইলে নতুন ভবনের দিকে যেতে বলে এবং ওই সময় নয়ন বন্ড নতুন ভবনের পাশের দেয়াল টপকিয়ে ভেতরে আসে। আমি হেঁটে নতুন ভবনের দিকে যাই এবং নয়নের সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারপিটের বিষয়ে কথা বলি। এরপর রিফাত শরীফ কলেজের ভেতর আসে এবং আমাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য সেখান থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলের কাছে নিয়ে আসে। কিন্তু আমি মোটোরসাইকেলে না উঠে সময়ক্ষেপণ করার জন্য পুনরায় কলেজ গেইটে ফিরে আসি। রিফাত শরীফ আমার পেছন পেছন ফিরে আসে। তখন রিশান ফরাজী কিছু ফোনালাপসহ আসে এবং জিজ্ঞাসা করে তুমি আমার বাবা-মাকে গালি দিয়েছো কেন?। রিফাত শরীফ বলে আমি গালি দেই নাই। ওই সময় রিফাত ফরাজী জামার কলার ধরে এবং রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে। রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয়, রিশান ফরাজীসহ রিফাত হাওলাদার এবং আরো অনেকে রিফাত শরীফকে পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মারধর করতে করতে এবং টেনে হেঁচড়ে ক্যালিক্সের দিকে নিয়ে যায়। ক্যালিক্সের সামনে তারা রিফাত শরীফকে এলোপাথারি মারধর শুরু করে। আমি তখন সবার পেছনে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ওই সময় নয়ন বন্ড ক্যালিক্সের সামনে এসে কিলঘুষি মারতে থাকে। মারপিটের মধ্যেই রিফাত ফরাজী, টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে যায় এবং রিফাত ফরাজী ২টি দা ও টিকটক হৃদয় এবং রিফাত হাওলাদার লাঠি নিয়ে আসে। ১টি দা দিয়ে নয়ন বন্ড ও ১টি দা দিয়ে রিফাত ফরাজী রিফাত শরীফকে কোপাইতে ছিল। রিশান ফরাজী রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখে যাতে রিফাত শরীফ পালাতে না পারে। রিফাত শরীফকে কোপাইতে দেখে আমি নয়ন বন্ডকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করি। দায়ের কোপের আঘাতে রিফাত শরীফ রক্তাক্ত হয়। সে
রক্তাক্ত অবস্থায় পূর্ব দিকে হেঁটে যায় এবং আমি রাস্তায় পড়ে থাকা জুতা পরি এবং উপস্থিত একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দিলে আমি রিকশায় করে ওকে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। এরপর আমার বাবাকে ফোন করি। আমার বাবা ও চাচা হাসপাতালে আসে। এরপর রিফাত শরীফকে বরিশাল পাঠানো হয়। আমার কাপড়-চোপড়ে রক্ত লেগে থাকায় আমি বাসা চলে যাই। পরে আমি জানতে পারি রিফাতের অবস্থা খারাপ। তখন নয়নকে ফোন করে বলি তোমরা তাকে যেভাবে কোপাইছো তাতে তো ও মারা যাবে এবং তুমি আসামি হবা। তারপর ওর অবস্থা জানতে চাই এবং পালাতে বলি। দুপুরের পর খবর পাই রিফাত শরীফ মারা গেছে।

রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে নিয়ে বর্তমানে তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের বাসায় রয়েছেন। জামিনের শর্তমতে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না মিন্নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৯
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।