ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আজও আঁতকে ওঠেন গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া গোপাল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯
আজও আঁতকে ওঠেন গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া গোপাল মৃতের ভান করে বেঁচে যান গোপাল রায়। ছবি: বাংলানিউজ

হবিগঞ্জ: দিনটির কথা মনে হলে এখনো ভয়ে আঁতকে ওঠে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার কৃষ্ণপুরবাসী। ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ১৩১ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে হানাদার বাহিনী, রাজাকারদের হাতে সম্ভ্রম হারান অনেক নারী। গণহত্যা থেকে বুদ্ধি ও ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া একজন গোপাল রায়। বয়স হয়েছে প্রায় ৯০ বছর। সেই দিনের ভয়াল দৃশ্য মনে হলে আজও কেঁপে ওঠেন তিনি। গণহত্যার ৪৮ বছরপূর্তিতে নিজের বেঁচে যাওয়ার সেই নাটকীয় ঘটনা জানিয়েছেন বাংলানিউজকে।

গোপাল রায় জানান, তখন ছিলেন টগবগে তরুণ আর ব্যবসায়ী। ’৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর সকালে সহকর্মীদের নিয়ে পসারী দোকানের মালামালসহ লাখাই উপজেলার মাদনা গ্রামে যাচ্ছিলেন।

হঠাৎ দেখেন, একজনকে গুলি করে মেরে ফেলেছে পাঞ্জাবীরা। সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড় দেন, তবে পালাতে পারেননি। তিনিসহ ধরা পড়েন অন্তত ১৭ জন।

গোপাল বলেন, আমাদের হাত পেছন দিয়ে বেঁধে নিলডাউন করিয়ে রাখে পাকিস্তানি সেনারা। মুহূর্তেই ব্রাশ ফায়ার। আমি দ্রুত গুলি লাগার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি ও মরার ভান ধরে অনেকক্ষণ ধরে পড়ে থাকি। পরে, পাকিস্তানিরা চলে গেলে মরদেহের স্তূপের ভেতর দিয়ে পালিয়ে যাই। সেদিনের কথা এখনো ভুলতে পারি না।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের এই দিনে ভোর ৪টা থেকে ৫টার দিকে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার সেনা ক্যাম্প থেকে একটি স্পিডবোট ও ৮-১০টি বাওয়ালী নৌকায় করে হানাদার বাহিনীর একটি দল ওই গ্রামে আসে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় লাখাই উপজেলার মুড়াকরি গ্রামের লিয়াকত আলী, বাদশা মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার ফান্দাউকের আহাদ মিয়া, বল্টু মিয়া, কিশোরগঞ্জের লাল খাঁ, রজব আলী, সন্তোষপুরের মোর্শেদ কামাল ওরফে শিশু মিয়াসহ ৪০ থেকে ৫০ জনের একদল রাজাকার-আলবদর। আর তাদের পরামর্শেই এ গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।

সেদিন পাকিস্তানি বাহিনী অন্তত ১৩১ জন পুরুষকে স্থানীয় কমলাময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে। পরে, আগুন দিয়ে গ্রামের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় ও লুটপাট করে। এছাড়া, গ্রামের অনেক নিরীহ নারীদের ওপর নির্যাতন চালায়। সকাল থেকে শুরু হওয়া এ হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।

কৃষ্ণপুর বধ্যভূমির সামনে স্থানীয় এমপি অ্যাডভোকেট মো. আবু জাহিরসহ অন্যরা।  ছবি: বাংলানিউজ

হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে গ্রামের শত শত নারী-পুরুষ পুকুরে কচুরিপানার নিচে আশ্রয় নেন। হানাদাররা চলে গেলে মরদেহগুলো উদ্ধার করে স্থানীয় বলভদ্র নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে গ্রাম ত্যাগ করেন তারা।

এ দিন হানাদারদের গুলি খেয়েও মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে থেকে প্রাণে রক্ষা পান গোপাল রায়, প্রমোদ রায়, নবদ্বীপ রায়, হরিদাস রায় ও মন্টু রায়সহ আরও কয়েকজন।

গোপাল রায়ের বয়স হয়েছে যথেষ্ট, চলাফেরা করতে কষ্ট হয়। চার মেয়ের বাবা তিনি। এই বয়সে নিজে আয় রোজগার করে অন্ন জোটানো সম্ভব নয় তার পক্ষে। সরকারের দেওয়া বয়স্ক ভাতা নিয়মিত পেলেও তাতে সংসার চলে না। এজন্য আরও সরকারি সাহায্যের দাবি জানিয়েছেন এ বৃদ্ধ।  

লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোসা. শাহীনা আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ১৮ সেপ্টেম্বর বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া, বেঁচে যাওয়াদের মুখ থেকে শোনা হবে সেই দিনের ভয়াল কাহিনী। গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়াদের সরকারিভাবে সহায়তার চেষ্টা করবেন বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৯
একে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।