ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘কষ্ট একটাই, মাইয়াডারে কোলে নিতা পারতাম না’ 

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১১ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৯
‘কষ্ট একটাই, মাইয়াডারে কোলে নিতা পারতাম না’ 

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার খোদাবক্সপুর গ্রামে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎসংযোগ দেওয়ার কথা বলে যশোরা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি সুমনের নেতৃত্বে একটি সিন্ডিকেট গ্রামের নীরিহ মানুষের কাছ থেকে ২ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। 

গ্রামবাসীর অনুরোধে তাদের বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করতে এগিয়ে এসেছিলেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য ইলিয়াস নোমান।

তার পদক্ষেপে ইতোমধ্যে গ্রামবাসী কাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎসংযোগও পেয়েছে।

কিন্তু এরই জেরে চিরদিনের জন্য নিজের বাম হাত হারিয়েছেন তিনি। বাংলানিউজকে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই বলছিলেন ইলিয়াস নোমান (২৯)।  

তিনি বলেন, খোদাবক্সপুর গ্রামের মানুষজনকে বিদ্যুৎ সংযোগ পাইয়ে দিতে চেষ্টা করাই আমার জন্য কাল হলো। সুমনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা রামদা দিয়ে আমার বাম হাত কেটে নিলো। আমি চিরদিনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলাম। পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়েই আমার বাকিটা জীবন কাটাতে হবে। ’

শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ২১৭ নম্বর কেবিনের বিছানায় শুয়ে বোবা কান্নার পাষাণ যন্ত্রণায় মোবাইল ফোনে বাংলানিউজকে এসব কথা বলেন সন্ত্রাসী হামলায় বাম হাত হারানো জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের এই নেতা।

নোমান রাজনীতির পাশাপাশি ঠিকাদারি করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রয়াত বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিলের চাচাতো বোনের ছেলে ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার নাতি।

গত ০২ সেপ্টেম্বর গফরগাঁও উপজেলার শিবগঞ্জ বাজার এলাকার পাশের একটি বাঁশঝাড়ে সন্ত্রাসীরা তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়।  

সেদিনের হামলার বর্ণনা দিয়ে নোমান বলেন, ‘আমি শিবগঞ্জ বাজার থেকে মোটর সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলাম। ওই এলাকার একটি বাঁশঝাড়ের কাছে আসার পরপরই আমাকে লক্ষ্য করে ওরা ঢিল ছুঁড়তে থাকে। সেই ঢিলে আমি মোটরবাইক থেকে মাটিতে পড়ে যাই।

‘আর তখনই তাৎক্ষণিক চাপাতি, রামদা, লোহার পাইপ ও রড দিয়ে আমার মাথায় আঘাত করতে থাকে। ওদের এলোপাতাড়ি কোপ আমার হাতে-পায়ে ও মুখে লাগে। আমি বেঁচে আছি না-কি মরে গেছি সেটাই ঠাহর করতে পারছিলাম না তখন। এরপর সন্ত্রাসী রাকিব, সুমন, ফয়সাল, মাহফুজ, ওলাদসহ ৮ থেকে ১০ জন চাপাতি ও রামদা দিয়ে আমার সারা শরীরে কোপাতে থাকে। এরপর তারা আমার বাম হাতে রামদা দিয়ে কয়েকটি কোপ দিলে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। জ্ঞান ফিরে দেখি আমার বাম হাত আর নেই,’ বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নোমান।

নোমানের দুই পায়ের পুরোটাতেই কোপের ক্ষত। ফলে সেখানে ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। মূলত তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিতভাবে এমন হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইলিয়াস নোমান।

নোমানের জীবনে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলেও ঠিকই কিলিং মিশনের পরের দিনই বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে স্থানীয় খোদাবক্সপুর গ্রামের বাসিন্দারা। হাউমাউ করে কেঁদে নোমান বলেন, ‘ওরা আমার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ আমাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এ জীবন বড় যন্ত্রণার। দুঃসহ কষ্টের অপর নাম। ’

সংকটাপন্ন জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগ সদস্য ইলিয়াস নোমান বাংলানিউজকে জানান, আমাকে সেদিন প্রথমে ভালুকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এবং পরে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অস্ত্রোপাচারের পর আমার বাম হাত কেটে ফেলা হয়।

ঢুকরে কেঁদে নোমান বলেন, এ ঘটনার পর আমার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার সন্ত্রাসী সুমনসহ ১০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ এখনও কোনো আসামিকে গ্রেফতার করছে না। আমি আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। যাতে ওরা আর কারো জীবনে এমন ক্ষতি করতে না পারে।

বাংলানিউজের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন তার পাশেই ছিল পাঁচবছর বয়সী মেয়ে ইশরাত নওরিনের। বাবার সঙ্গে আলাপন মোবাইলের অপ্রাপ্ত থেকে ভেসে আসছিল।  

বললেন, ‘ভাই, আমার অহন একটাই কষ্ট। আমার মাইয়াডারে আর কোলে নিয়ে ঘুরতে পারতাম না। মানবজীবনে এর থাইক্যা বড় কষ্ট আর নাই রে, ভাই। ’ 

এ বিষয়ে গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অনুকূল সরকার বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনাটি আমি আসার আগেই ঘটেছে। ঠিক কী কারণে এ ঘটনাটি ঘটেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আমরা মামলা দায়েরের পর ইতোমধ্যেই সারোয়ার জাহান ওরফে ধনু নামে একজনকে গ্রেফতার করেছি। বাকিরা পলাতক।  

তবে তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৯
এমএএএম/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad