ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

খুলনাঞ্চলের মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যমদূত!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১, ২০১৯
খুলনাঞ্চলের মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে যমদূত! মহাসড়কে চলছে তিনচাকার ইজিবাইক। ছবি- তারিকুল ইসলাম

খুলনা: উচ্চ আদালতের রায়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ কিছুই যেন কাজে আসছে না। খুলনাঞ্চলের সড়ক ও মহাসড়কে ‘যমদূতের’ মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ যানবাহন। ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত প্রাণ ঝরালেও এসব যানবাহন চলাচল বন্ধ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার পর পুলিশ কিছুদিন অভিযান চালায়, তারপর এক সময় সে অভিযান স্তিমিত হয়ে পড়ে। ফের চলতে শুরু করে তিন চাকার যানবাহনগুলো।

নিয়ম অনুযায়ী কোনো মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। কিন্তু খুলনাঞ্চলের মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, অটোটেম্পু, লেগুনা ও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে দাপটের সঙ্গে।

মহাসড়কের দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে এসব যানবাহনকে দায়ী করছেন অনেকে। তবে দায়ী করার বিষয় নয়, বিভিন্ন সময়ে বড় বড় দুর্ঘটনায় এসব যানবাহনের সংশ্লিষ্টতাই খুঁজে পাওয়া যায়।

আবার কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, এসব যানবাহন থেকে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের একটি সিন্ডিকেট টোকেনের মাধ্যমে প্রতিদিন গাড়ি প্রতি চাঁদা আদায় করে। যার একটি ভাগ দেওয়া হয় পুলিশ ও প্রশাসনকে।

আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে মহাসড়ক থেকে তিন চাকার যানবাহন সরিয়ে নিতে গিয়ে প্রভাশালীদের তোপের মুখে পড়ছেন হাইওয়ে পুলিশ। এসব গাড়ি জব্দ করতে গেলে হাইওয়ে পুলিশকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন প্রভাবশালীরা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খুলনা মহানগরীর মহাসড়কে এবং খুলনা-যশোর, খুলনা-সাতক্ষীরা, খুলনা-বাগেরহাট, খুলনা-মোংলা মহাসড়কে ইজিবাইক, অটোরিকশা, টেম্পোসহ অযান্ত্রিক সব ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। সবচেয়ে বেশি ইজিবাইক, লেগুনা ও মাহেন্দ্র চলছে খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে। এসব এলাকায় পুলিশের কোনো অভিযান নেই বললেই চলে।

রাত-দিন অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে এসব যানবাহন। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই বেপরোয়া গতিতে এসব যান চালাচ্ছেন চালকরা। ফলে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।

মহাসড়কে চলছে তিনচাকার ইজিবাইক।  ছবি- তারিকুল ইসলামদুর্ঘটনার পাশাপাশি ধীরগতির এসব যানবাহনের কারণে মহাসড়কে যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। বাস-ট্রাক কাঙ্ক্ষিত গতিতে চলতে পারছে না। এতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বাড়তি সময়ের কারণে ব্যয় বাড়ছে।

এ বিষয়ে খর্নিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহমুদ আলম বাংলানিউজকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা মহাসড়কগুলোতে তিন চাকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করার চেষ্টা করছি। সচেতনতার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছি। হেড কোয়ার্টারের নির্দেশ অনুযায়ী চালকদের নামে মামলা ও গাড়ি আটক করছি।

খুলনার মতো যশোর, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা জেলার সড়ক-মহাসড়কেও তিন চাকার অবৈধ যানবাহন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

বাংলানিউজের যশোরের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট উত্তম ঘোষ জানান, যশোরের সব মহাসড়কে ইজিবাইক চলাচল করে। যশোর-খুলনা, যশোর-বেনাপোল, যশোর-ঝিনাইদহ ও যশোর-মাগুরা মহাসড়কের পাশাপাশি আঞ্চলিক মহাসড়কেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নিষিদ্ধ এসব যানবাহন।

অভিযোগ রয়েছে, ইজিবাইক মালিক-শ্রমিকদের নামে একাধিক সংগঠন চাঁদা তুলে সব সংস্থাকে ম্যানেজ করে মহাসড়কে এসব অবৈধ যান চালাচ্ছে। এতে বেড়েই চলেছে দুর্ঘটনা।

যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনছার উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, মহাসড়কে ইজিবাইকসহ সব ধরনের অবৈধ যানবাহন বন্ধে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। এছাড়াও জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে সবার সহযোগিতা চেয়ে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়ার কার্যক্রম, সচেতনতা মাইকিং কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

বাগেরহাট ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট এস.এস শোহান জানিয়েছেন, বাগেরহাটের মহাসড়কগুলোতে এখনও অটো, ভটভটি ও নসিমন চলছে দাপটের সঙ্গে। বাগেরহাট-পিরোজপুর মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে বাধাল পর্যন্ত নিয়মিত অটো চলাচল করে। খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের নওয়াপাড়া থেকে বাগেরহাট বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত রাতে মাহেন্দ্রা চলে। এছাড়া সাইনবোর্ড-বগী আঞ্চলিক মহাসড়কে সাইনবোর্ড থেকে মোড়েলগঞ্জ ফেরি ঘাট পর্যন্ত প্রায় শতাধিক অটো চলাচল করে।

অটো চালকদের দাবি, অনেক টাকায় অটো ক্রয় করে সরকারি সিদ্ধান্তে অটো চালানো বন্ধ রাখলে না খেয়ে মরতে হবে তাদের।

অটো চালক মো. ফিরোজ বলেন, অটো চালিয়ে কোনো মতে আয় করে সংসার চালাই। সেই অটো চালানো বন্ধ রাখলে না খেয়ে মরতে হবে।

নারায়ণ নামের আরেক চালক বলেন, অনেক কষ্ট করে দেড়-দুই লাখ টাকা দিয়ে অটো কিনেছি। এখন বন্ধ করলে আমাদের টাকার কি হবে। আর আমরা কি করে খাবো।

কাটাখালী হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল ইসলাম বলেন, মহাসড়কে নসিমন, করিমন, ভটভটি ও অটো চলাচল বন্ধ করতে আমরা প্রায়ই অভিযান পরিচালনা করে থাকি। জনসচেতনতার জন্য মাইকিং অব্যাহত রয়েছে। এরপরে কেউ কেউ মহাসড়ক দিয়ে চলছে। এজন্য প্রতিদিন আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

কুষ্টিয়া ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, কুষ্টিয়ার সব সড়ক এবং মহাসড়কে ইজিবাইক চলাচল করে। সেই সঙ্গে চলে সিএনজিচালিত অটোরিকশাও। এর মধ্যে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর, কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া-ঈশ্বরদী, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী মহাসড়ক ও কুষ্টিয়া-মিরপুর, কুষ্টিয়া-দৌলতপুর, ভেড়ামারা, কুমারখালী, চুয়াডাঙ্গা আঞ্চলিক সড়কে দিন রাত ইজিবাইকসহ তিন চাকার অবৈধ যান দাপিয়ে বেড়ায়।

চুয়াডাঙ্গা ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট জিসান আহমেদ জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গা-আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর, চুয়াডাঙ্গা-ঝিনাইদহ আঞ্চলিক সড়কে হরহামেশা চলছে ইজিবাইকসহ তিন চাকার যান।

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সড়কে এক সময় চলাচল করতো, তবে কিছুদিন আগে বাস মালিক শ্রমিকদের সঙ্গে একটি দ্বন্দ্বের কারণে এখন শহরের বাইরে ইজিবাইক চলাচলে বাধা দিচ্ছে পুলিশ।

অনূরূপভাবে সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুর, নড়াইল, মাগুড়ার অনেক সড়ক-মহাসড়কে কম বেশি চলাচল করছে ইজিবাইকসহ নিষিদ্ধ তিন চাকার যান। এতে প্রতিনিয়ত ছোটবড় দুর্ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টরা।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এস এম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বাংলানিউজকে বলেন, আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে মহাসড়কে কিভাবে ইজিবাইকসহ তিন চাকার যান চলে তা খতিয়ে দেখা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। কেননা এসব যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। ঝরছে মানুষের প্রাণ।

তিনি বলেন, ইজিবাইক চলাচলের অনুমতি নেই, আবার আমদানিতেও বাধা নেই। যা হাস্যকর। নিষিদ্ধ জিনিস আমদানি করতে দেওয়া উচিত নয়। বিষয়টি সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার দাবি জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৯
এমআরএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।