ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত ২ গ্রাম যমুনার পেটে

বেলাল হোসেন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৯
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত ২ গ্রাম যমুনার পেটে

বগুড়া: ‘নদীর এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা/সকাল বেলার আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা…’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের নদীকে নিয়ে চিরন্তন সুর। সেই সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নদী ভাঙন আর চর জেগে ওঠার এই খেলা যেন খেলেই চলছে নিরন্তর।

ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা। কোনো এক নেতার ভাষ্যমতে, ‘বান-তুফানে বসতবাড়ি কিছু না কিছু পাওয়া যায়।

আগুনে পুড়লে কিছু না পেলেও ছাই পাওয়া যায়। কিন্তু নদী ভাঙনে হারিয়ে যায় সর্বস্ব। চোখের জল আর জীবনটা ছাড়া কিছুই থাকে না। কখনো কখনো জীবনটাও চলে যায়’। তাইতো ‘নদীর ধারো বাস ভাবনা বারো মাস। ’
 
রাধানগর ও বৈশাখী গ্রাম কবির সেই চিরন্তর সুরের নামান্তরই মাত্র। যমুনার বুকে জেগে ওঠা বিশাল চর নিয়ে গ্রাম দু’টি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু ভাঙা-গড়ার খেলায় গ্রাম দু’টি বিলিন হয়ে যেতে থাকে যমুনায়। এবারের বন্যায় হিংস্র যমুনার পেটে চলে যায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত এই দু’টি গ্রাম।
  
যমুনার পাড়ে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া সেই চরের দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে ছিলেন জহেরা বেগমসহ আরেক নারী। যমুনার সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করে বংশ পরম্পরায় রাধানগর গ্রামে স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করে আসছিলেন এই নারী। কিন্তু প্রত্যেক বছর বন্যায় যমুনার ভাঙনে গ্রামটি ছোট হয়ে আসছিল। এবারের বন্যায় পুরোটাই গিলে নিয়েছে যমুনা। এ অবস্থায় জহেরা বেগমের জীবন ছন্নছাড়া।
 
বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্বদিকে জেগে ওঠা যমুনার চরে রাধানগর ও বৈশাখী গ্রামের অবস্থান ছিল। সর্বশেষ যমুনায় বিলিন হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরো গ্রাম দু’টিতে চার শতাধিক পরিবার বসবাস করতো। সম্প্রতি মাসখানেকের বন্যায় গ্রাম দু’টি পুরোপুরি গিলে নিয়েছে প্রমত্তা যমুনা। এতে জহেরা বেগমের মতো গ্রাম দু’টিতে বসবাসকারী মানুষ ভিটেমাটি হারা হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।  গবাদিপশু নিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন মানুষ।  ছবি: বাংলানিউজ‘১৯৮২ সালে যমুনায় জেগে ওঠা রাধানগর গ্রামটি যমুনার ভাঙনে একেবারে বিলিন হয়ে যায়। বিলিনের আগে সেই গ্রামে জোতদার রিফাস মণ্ডলের শতাধিক বিঘা জমি ছিল’ তার ছেলে মোহাম্মদ আলীর ভাষ্য ছিল এমনটা।
 
তিনি বাংলানিউজকে জানান, প্রায় ২৫ বছর আগে বিশাল আকার নিয়ে আবারও জেগে ওঠে চরটি। ধীরে ধীরে সেখানে আগের মতোই জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। সময়ের ব্যবধানে আগের মতো চরের বুকে জেগে ওঠা রাধানগর গ্রাম মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে।
 
কিন্তু যা হওয়ার তাই। যমুনার স্বভাব মতো প্রতিবছর বন্যায় গ্রামটি ভাঙতে থাকে। ছোট হয়ে আসতে থাকে রাধানগর। এবারের বন্যায় পুরো গ্রাম যমুনার পেটে চলে গেছে। সবকিছু হারিয়ে মানুষজন বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ অন্যত্র আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে যোগ করেন মোহাম্মদ আলী।
 
একইভাবে প্রায় ২০ বছর আগে যমুনায় জেগে ওঠা চরে বৈশাখী গ্রাম। ওই গ্রামের বাসিন্দা সামছুল ইসলাম ও গোলাম রব্বানী বাংলানিউজকে জানান, রাধানগর গ্রামের মতো সময়ের ব্যবধানে এই গ্রামটিতেও জনবসতি গড়ে ওঠে। শিক্ষার জন্য গ্রামটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এসবই এখন স্বপ্নের মতোন মনে হয়। কারণ এবারের বন্যায় এ গ্রামটিও যমুনার পেটে চলে গেছে। হারিয়ে গেছে মানচিত্র থেকে। নিদারুন কষ্টের মধ্যে রয়েছে গ্রামের মানুষগুলো।
 
হাবিবুর রহমান, মোসলেম উদ্দিনসহ কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি বাংলানিউজকে জানান, মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাওয়া এই চরের সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীণ প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে যাওয়ার আগে চরের এই দু’টি (রাধানগর ও বৈশাখী) গ্রামে অবস্থান নিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। যে যেভাবে পারতেন গোপনে তাদের জন্য খানাপিনার ব্যবস্থা করতেন। সেখান থেকে ভারতে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতেন।  
 
এখান থেকে ভারতে যেতেন নৌকাযোগে। তাদের ভারতে যাওয়ার রুট ছিল কুড়িগ্রাম জেলার মাইনকার চর হয়ে। প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরতেন। যে যার মতো দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে অংশ নিতেন মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজড়িত সেই গ্রাম দু’টিও আজ হিংস্র যমুনার থাবায় মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেল যোগ করেন এই প্রবীণ ব্যক্তিরা।
      
ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আতিকুল করিম আপেল বাংলানিউজকে জানান, এবারের বন্যায় চরের এই দু’টি গ্রামের চার শতাধিক পরিবারের বসতভিটা যমুনায় বিলিন হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব পরিবারের তালিকা তৈরি করে উপজেলা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট দফতরে জমা দেওয়া হয়েছে।    
 
ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিয়া সুলতানা বাংলানিউজকে জানান, সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কাজ চলমান রয়েছে। প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১১৩৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০১৯
এমবিএইচ/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।