ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দু’কূলেই জীবনতরী বেয়ে যাচ্ছেন ‘চাশ্রমিক ময়না’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৯
দু’কূলেই জীবনতরী বেয়ে যাচ্ছেন ‘চাশ্রমিক ময়না’ নিজের জমিতে ধান রোপণ করছেন চাশ্রমিক ময়না। ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: চায়ের পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে কসপূর্ণ হয়ে গেছে তার দু’হাতের আঙুলগুলো। সহজে তা উঠে যাওয়ার নয়। তার মধ্যে বয়স্ক হাতের রেখাগুলো তীব্র হয়ে চায়ের কসকে তার ভেতর লেগে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে স্পষ্টভাবে। প্রক্রিয়াজাত চা-পাতা মেশিনের ভেতর পৌঁছে দেওয়া কাজের দক্ষকর্মী হলেন তিনি।

এদিকে ৮ ঘণ্টার পেশাগত চা কারখানার কাজ সেরে বাসায় এসেই ধানক্ষেতের মায়া পেয়ে বসে তার। বসে থাকার একদম সময় নেই যে।

নিজের ক্ষেতে কাজে যেতে হবে। ক্ষেতের ধান কেমন আছে দেখতে হবে। খুব ভোরে উঠে দু’ঘণ্টা ক্ষেতে কাজ করে তারপর পেশাগত কর্তব্যে ছুট। মাঠের বাতাস হঠাৎ এসে কখনো কখনো শরীরে শান্তির পরশ বুলিয়ে যায় তার। করিৎকর্মা মুহূর্ত জানান দেয় তার দুটো কাজের অভিজ্ঞতাটুকু।

এভাবেই বছরের পর বছর ধরে নিজ জমিতে ধান চাষ করে জীবনসংগ্রামে টিক থাকার দারুণ লড়াইমুখর ময়না সিং রাউতিয়া। কৃষিতেও টিকে থাকার দুর্বার সংগ্রম চাশ্রমিক তার। পেশায় তিনি জাগছড়া চা বাগানের কারখানা শ্রমিক।

তিনি চা বাগানের স্থায়ী শ্রমিক। ১৪ নম্বর শ্রমিক লাইনে বসবাস করেন তিনি। বাড়ির পাশেই রয়েছে তার বিশাল ধানক্ষেত। জমি কখনো পরিত্যক্ত হয়ে থাকে না, সারাবছরই ধানপূর্ণ থাকে। এভাবে কৃষিতেও সফল চা শ্রমিক ময়না। সকালটি মেঘময়।

স্নিগ্ধতাটুকু ঘিরে শান্তিময় হয়ে আছে চা-প্রকৃতি। জাগছড়া চা বাগানের চৌদ্দ লাইনের প্রবেশমুখের পশ্চিমপাশে টিলাঘেঁষা ধানক্ষেত। কিছুটা ঝিল থাকায় পানি নিশ্চয়তাটুকু পাওয়া যায় সারাবছরই। ফলে কৃষিসম্ভাবনার উর্বর এক টুকরো অংশ এটি। নিয়মিতভাবে চা বাগানের কাজ এবং দৈনিক নিজের ধানক্ষেতের কাজ-এই দু’কূলেই জীবনতরী বেয়ে চলেছেন চাশ্রমিক ময়না সিং রাউতিয়া। ময়নার ছোট্ট পরিবার। কাছে যেতেই মৃদু হাসে স্বাগত জানালেন ময়না। বিভিন্ন কথোপকথনে তিনি বলেন, কোনোভাবে টিকে আছি বাবু। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে খেতে হয়। বাগানের কাজে তো আর সংসার চলে না। তাই অতিরিক্ত যে টুকু সময় পাই তা নিজের ধানক্ষেতে সময় দেই। সাড়ে ৩ কিয়ার (৩০ শতাংশ জমিতে ১ কিয়ার) ভূমি রয়েছে আমার।     

সারাবছর কী কী জাতের ধান চাষ করেন? এ প্রশ্নে কৃষক ময়না সিং রাউতিয়া আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলেন, আমার জমিতে কয়েকটি ছোট ছোট ঝিল আছে। তাই সারাবছরই মোটামুটি পানি থাকে। তবে, বৈশাখ-আষাঢ় পর্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হলে পাহাড়ি ঢলে এলাকা একেবারে ডুবে যায়। আবার ঘণ্টা দু’এক পর ছড়া দিয়ে পানি চলে যায়। তাই ‘বিআর-১১’ (আমন), ‘ব্রিধান-২৮’ (আমন-বোরো), ‘স্বর্ণ-৫’ (আমন ধান) প্রভৃতি জাতের বন্যা প্রতিরোধক বা অতিরিক্ত পানিসহিষ্ণু ধান লাগাতে হয়। তবে ফসল খারাপ হয় না।    

বৈবাহিক জীবনে এক মেয়ে ঝর্ণা সিং রাউতিয়া (১২) এবং এক ছেলে ঋত্ত্বিক সিং রাউতিয়া (১২) এর জনক ময়না। ছেলেটি বাড়ি থেকে এবং মেয়েটি নিকটাত্মীয় বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে। স্ত্রী লক্ষ্মী সিং রাউতিয়া ঘরের কাজকর্ম সামলান। তবে তিনি বাগানের অস্থায়ী নারী শ্রমিক (চুক্তিভিত্তিক) হিসেবে তালিকাভুক্ত থাকায় মধ্যে মধ্যে চা বাগানের কাজেও যান।

চাশ্রমিকদের তো অনেক সন্তানাদি হয়ে থাকে, আপনার মাত্র দু’জন কেন? এর উত্তরে হাসি ছড়িয়ে বলেন, সংসার ছোট হলে ঘরে সুখ, শান্তি, আনন্দ বজায় থাকে। এ কথাটা আমাদের চাশ্রমিকরা বিশ্বাস করতে চায় না বলে বড় সংসার করে বিপদে পড়ে।

চাশ্রমিক ও কৃষক দুটোতেই তো সফল আপনি। অন্যরা হিংসা করে না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাবু, আমি তো আগেই বলছি পরিশ্রমের উপর কুচ্ছু নাই বাবু। এদের জিগান, এরা আমার মতো পরিশ্রম করতে পারবে? পারবে না। আমি আমার বউ-সন্তানদের কথা ভেবে প্রতিদিন পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করে যাই।

ময়নার এমন কড়া উত্তরে জটলা হয়ে বসে থাকা এলাকার চাশ্রমিক লোকজনের মধ্যে কিছুটা বিব্রতভাব ছড়িয়ে পড়ে। এ বিব্রতভাবকে পাশ কাটিয়ে ১০ জনের ভেতর থেকে দু-চারজন উঠে যেতে থাকেন। ময়না তখন মুখ ঘুরিয়ে আবার তার ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকেন।   

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৯
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।