ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের ছড়াছড়ি, সংখ্যা জানে না কর্তৃপক্ষ

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৯
অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের ছড়াছড়ি, সংখ্যা জানে না কর্তৃপক্ষ অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। ছবি: বাংলানিউজ

রেলপথের অবস্থা বেশ নাজুক। কোথাও বছরের পর পর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে পচন ধরেছে স্লিপারে। কোনো কোনো স্থানে আবার অস্তিত্বই নেই নাট-বল্টু বা হুকের। বেহাল অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ রেল সেতুগুলোরও। ফলে ট্রেনযাত্রা হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক। আবার অরক্ষিত রেলক্রসিংও হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। কিন্তু এসব যেন দেখার নেই কেউ-ই। সরেজমিনে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন আমাদের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। ছবি তুলেছেন অনিক খান। আজ পড়ুন ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ কিস্তি।

ময়মনসিংহ: নগরীর সানকিপাড়া রেলক্রসিংয়ের পাশেই কাঁচাবাজারে জমজমাট বেচাকেনা চলছে। হুইসেল বাজিয়ে আসছে ট্রেন।

গেটম্যান সিরাজুল ইসলাম এক পাশের গেট ব্যারিয়ার ফেলেছেন। অন্যপাশে কোনো ব্যারিয়ার না থাকায় পুরোটাই অরক্ষিত।

ফলে রেললাইন থেকে মাত্র দেড় হাত দূরে রিকশা, মোটরসাইকেলসহ অন্যান্য যান ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জেনেবুঝেই জীবনবাজি রেখে যেন লাইনঘেঁষেই অবস্থান নিয়েছেন প্রত্যেক চালক ও আরোহী। প্রশ্ন করতেই সিরাজুল উত্তর দিলেন, ‘৩ থেকে ৪ বছর ধরে গেট ব্যারিয়ার নেই। তারের সমস্যার জন্য এখানে গেট ব্যারিয়ার লাগানো যাচ্ছে না। ’

এ তো গেলো গেটম্যান থাকলেও গেট ব্যারিয়ার না থাকার গল্প। আর সদর উপজেলার খাগডহর ইউনিয়নের কিসমত তাঁরাগাই রেলক্রসিং এলাকার চিত্রই আলাদা। এখানে গেটম্যান বা গেট ব্যারিয়ার কোনোটিই নেই। এ রেলপথে কোনো ট্রেন গেলে স্থানীয় জনসাধারণ নিজেরা খালি গলায় চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করেন।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বিয়ের মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কায় বর-কনেসহ ১১ জন নিহতের ঘটনার পর আবারো আলোচনায় এসেছে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের বিষয়টি। ময়মনসিংহ রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ময়মনসিংহের ২০২ কিলোমিটার রুটে কতগুলো রেলক্রসিং অনুমোদিত, কতগুলো অননুমোদিত এবং কতগুলো অরক্ষিত সে বিষয়ে কোনো তথ্যই জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ।

কয়েক দফা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও ঝুঁকিপূর্ণ রেলক্রসিং সম্পর্কে নিজের অজ্ঞতার স্বাক্ষর রেখেছেন ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) সুকুমার বিশ্বাস। তবে বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ দীর্ঘ রেলপথে কমপক্ষে দেড় শতাধিক রেলক্রসিং অরক্ষিত।

কোথাও নামমাত্র সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দায় এড়িয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। কিছুক্ষণ পরপরই ট্রেন আসা-যাওয়া করায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পারাপার হতে হচ্ছে যানবাহনের যাত্রী ও স্থানীয় লোকজনকে।

নগরীর ব্যস্ততম মিন্টু কলেজ রেলক্রসিং হয়ে জামালপুর থেকে ছেড়ে আসা অগ্নিবীণা আন্তঃনগর ট্রেন ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনে যাওয়ার সময় একদিকে গেট ব্যারিয়ার ফেললেন গেটকিপার মনির হোসেন মিন্টু। ট্রেন কাছাকাছি চলে এলেও আরেক দিকে কোনো প্রতিবন্ধক না থাকায় মোটরসাইকেল চালক ও পথচারীরা ঢুকে পড়ছেন।

বিষয়টি সম্পর্কে প্রশ্ন করলে মিন্টু জানান, সবার মধ্যেই তাড়া। একদিকে গেট ব্যারিয়ার নষ্ট থাকায় কেউ আইন মানে না। আমি নিয়ম অনুযায়ী ওয়ার্নিং বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে এক পাশের গেট ব্যারিয়ার ফেলেছি।

গুরুত্বপূর্ণ এ রেলক্রসিংয়ের গেট ব্যারিয়ার নষ্ট থাকার বিষয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট জহিরুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, ‘ক’দিন আগে ওই গেট ব্যারিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে। ঠিক করার জন্য কাজ চলছে। অন্য কোথাও এ সমস্যা নেই। ’

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ময়মনসিংহ-ঢাকা, ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহ-জামালপুর রুটের বিদ্যাগঞ্জ ও ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথের মোট ২০২ কিলোমিটার রুটে ২১০টির মতো লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদন রয়েছে ৬০ থেকে ৬৫টির। দেড়শ’র মতো রেলক্রসিং অননুমোদিত। বেশিরভাগেই গেটম্যান বা গেট ব্যারিয়ার নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অননুমোদিত রেলক্রসিংয়ের বেশিরভাগই নির্মাণ করেছেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) বা ইউনিয়ন পরিষদ। ফলে এসব রেলক্রসিং’র কোনো দায় রেলওয়ে না নেওয়ায় এগুলোকে প্রকারান্তরে ‘অবৈধ’ বলেই ধরে নেওয়া হয়।

স্থানীয় রেলওয়ের একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, সাধারণত এসব রেলক্রসিং নিজ দায়িত্বে পারাপার হতে হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট যান চালককে ক্রসিংয়ের সন্নিকটে এসে থামতে হয়। পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সতর্কতার সঙ্গে রেলক্রসিং পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই চালকরা বেপরোয়া হওয়ায় উল্লাপাড়ার মতোই দুর্ঘটনা ঘটে।

সূত্র জানায়, সাধারণত নগরীর ভেতরকার রেলক্রসিংগুলোতে ৬ জন করে নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসব রেলক্রসিংয়ে দুই থেকে তিনজনের বেশি প্রহরী নেই। আর অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোতে সাকুল্যে একজন নিরাপত্তা প্রহরী দায়িত্ব পালন করেন। এসব ক্ষেত্রে জনবলের অভাবকেই দায়ী করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী (এইএন) সুকুমার বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, প্রতিটি রেলক্রসিংয়ে জনবল নিয়োগের বিষয়টি উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। রেল আইন অনুযায়ী রেল লাইনের ওপর দিয়ে সড়ক করলে আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করতে হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ আইন মানছে না। ফলে অবৈধ রেলক্রসিংয়ের সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৫ ঘণ্টা, জুলাই ২৮, ২০১৯
এমএএএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।