ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সেই সেতুর অর্ধেক স্লিপারই নষ্ট, আবেদনেও মেলেনি বরাদ্দ

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৯
সেই সেতুর অর্ধেক স্লিপারই নষ্ট, আবেদনেও মেলেনি বরাদ্দ রেললাইনের স্লিপার নষ্ট হয়ে নাজুক দশা তৈরি হয়েছে। ছবি: অনিক খান

রেলপথের অবস্থা বেশ নাজুক। কোথাও বছরের পর পর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে পচন ধরেছে স্লিপারে। কোনো কোনো স্থানে আবার অস্তিত্বই নেই নাট-বল্টু বা হুকের। বেহাল অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ রেল সেতুগুলোরও। ফলে ট্রেনযাত্রা হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক। আবার অরক্ষিত রেলক্রসিংও হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। কিন্তু এসব যেন দেখার নেই কেউ-ই। সরেজমিনে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন আমাদের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। ছবি তুলেছেন অনিক খান। আজ পড়ুন ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় কিস্তি।

ময়মনসিংহ: কাঠের স্লিপারের ওপর লাইন বসিয়ে আটকানো হয় ক্লিপ দিয়ে। প্রতিটি স্লিপারের দুই পাশে কমপক্ষে ৮টি করে ক্লিপ থাকার নিয়ম রয়েছে।

কিন্তু বেশিরভাগ স্লিপারের সঙ্গেই ক্লিপের বালাই নেই! উল্টো পচে নষ্ট হয়ে গেছে একেকটি স্লিপার। আবার যেগুলো টিকে আছে সেগুলোর অবস্থাও নাজুক।

বলা হচ্ছে, ৬৬২ স্লিপারের মধ্যে প্রায় অর্ধেক স্লিপারই পুরোদমে অকেজো হয়ে পড়েছে। জরাজীর্ণ এমন চিত্র ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ৯০০ মিটার দীর্ঘ রেলসেতুর। এ সেতুর দুই পাশে রেলিং নেই। শুধু তাই নয়, হুক বোল্ট ও ডগ স্পাইক দুর্বৃত্তরা হরহামেশাই চুরি করে নিয়ে যাওয়ায় সব মিলিয়ে চরম ঝুঁকিতে রয়েছে সেতুটি।

এরপরও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ সেতু ব্যবহার করে ময়মনসিংহ-ভৈরব, ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহ-চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি রুটে ট্রেন চলাচল করছে। অথচ উনিশ-বিশ হলেই এ সেতুটিতেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। রেললাইনের স্লিপার নষ্ট হয়ে নাজুক দশা তৈরি হয়েছে।  ছবি: অনিক খানএতো কেবল ব্রহ্মপুত্র রেলসেতুর দৈন্যদশা। জেলার গফরগাঁওয়ের শিলা নদীর ওপর কাওরাইদ সেতু ও নেত্রকোণার কংস নদীর ওপর সেতুও চরম আতঙ্ক তৈরি করছে প্রতিনিয়ত। দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ এ দু’টি সেতু সংস্কারেও কার্যকর উদ্যোগ নেই।

স্থানীয়রা যেকোনো সময়ে দুর্ঘটনার আশংকা করছেন। এসব সেতু মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দের আবেদন করেও কিনারা হয়নি। বরাদ্দ না পাওয়ায় সংস্কার কাজেও হাত দেওয়া যাচ্ছে না।

স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, গফরগাঁও উপজেলার মশাখালী ও কাওরাইদের মাঝখানে শিলা নদীর ওপর কাওরাইদ সেতুটি চার বছর আগে এবং গফরগাঁও ও মশাখালী স্টেশনের মাঝখানে বাসুটিয়া সেতুটি প্রায় এক যুগ আগে সংস্কার করা হয়েছিল। এরপর এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো দৃষ্টি নেই।

জানা যায়, ময়মনসিংহ-ঢাকা, ময়মনসিংহ-ভৈরব, ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ-জারিয়া ও ময়মনসিংহ-জামালপুর রেলপথে ময়মনসিংহ জোনের ২০২ কিলোমিটার রেলপথে বড়-ছোট মিলিয়ে প্রায় পৌনে তিন শতাধিক সেতু-কালভার্ট রয়েছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এ তিনটি সেতুই সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।  

স্থানীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে রেলের গোড়াপত্তনের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে অছে ব্রহ্মপুত্র রেলসেতু। ৮০’র দশকের আগ পর্যন্ত এটিই ছিল ব্রহ্মপুত্রের ওপর একমাত্র সেতু। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ হানাদারমুক্ত হওয়ার আগের রাতে অর্থাৎ ৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মধ্যরাতে পাকিস্তানিরা রেলসেতুটি ভেঙে দিয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর এ রেলসেতুটি সংস্কার করা হয়। এরপর কেটেছে দীর্ঘ সময়। এ সময়ে এ সেতুর ভাগ্যে জুটেছে অযত্ন আর অবহেলা। এমনকি সেতুর পুরাতন কাঠের ৬৬২টি স্লিপারের মধ্যে  কমপক্ষে অর্ধেক স্লিপারই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক স্থানে নাট-বল্টুর হদিস নেই। রেললাইনের স্লিপার নষ্ট হয়ে নাজুক দশা তৈরি হয়েছে।  ছবি: অনিক খানসরেজমিনে আরো জানা গেছে, প্রতিনিয়তই রাতের আঁধারে এ সেতুর রেললাইনের মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাচ্ছে। অনেক জায়গায় হুক বোল্ট ও ডগ স্পাইকের অস্তিত্ব নেই। নগরীর কেওয়াটখালী রেলওয়ে লোকোশেড সংলগ্ন এই সেতুটির নিরাপত্তায় কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেতুটি কার্যত ‘মৃত্যুফাঁদে’ রূপ নিচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয় কেওয়াটখালীর বাসিন্দা মহানগর যুবলীগ নেতা আল-আমিন বাংলানিউজকে জানান, চরম আতংক নিয়ে এ সেতু ব্যবহার করে নেত্রকোণার-জারিয়া ও মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, ভৈরব, চট্টগ্রাম ও সিলেট রুটে কয়েক হাজার যাত্রী প্রতিদিন চলাচল করেন। এ সেতুটি সংস্কারের দাবি জোরালো হলেও সিলেটের দুর্ঘটনার পরও কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।

আলাপ হলো ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী কমিউটার ট্রেনের যাত্রী শরীফুল ইসলাম। তিনি স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। শরীফুল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ সেতুটির ওপর ট্রেন উঠলেই আতংকে বুক কেঁপে উঠে। বড় রকমের দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলে দায় কে নেবে এমন প্রশ্নও করেন এ যাত্রী।

ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহ-সভাপতি শঙ্কর সাহা বাংলানিউজকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে নির্মিত জরাজীর্ণ এ সেতুর সংস্কার এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনে এ সেতু পুনর্নির্মাণে জরুরি ভিত্তিতে উদ্যোগ নিতে হবে।

এসব বিষয়ে ময়মনসিংহ রেলওয়ের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সুকুমার সরকার বাংলানিউজকে জানান, ব্রহ্মপুত্র রেলসেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ এমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে স্লিপারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এজন্য উচ্চ পর্যায়ে বছর খানেক আগে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত বরাদ্দ মেলেনি। বরাদ্দ পেলেই প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ শুরু হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৬ ঘণ্টা, জুলাই ২৭, ২০১৯
এমএএএম/জেডএস

*** পাথরবিহীন রেলপথে উধাও নাট-বল্টু, পচন স্লিপারেও

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।