ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পাথরবিহীন রেলপথে উধাও নাট-বল্টু, পচন স্লিপারেও

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৭ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
পাথরবিহীন রেলপথে উধাও নাট-বল্টু, পচন স্লিপারেও

রেলপথের অবস্থা বেশ নাজুক। কোথাও বছরের পর পর অযত্নে অবহেলায় পড়ে থেকে পচন ধরেছে স্লিপারে। কোনো কোনো স্থানে আবার অস্তিত্বই নেই নাট-বল্টু বা হুকের। বেহাল অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ রেল সেতুগুলোরও। ফলে ট্রেনযাত্রা হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক।

আবার অরক্ষিত রেলক্রসিংও হয়ে উঠেছে মরণফাঁদ। কিন্তু এসব যেন দেখার নেই কেউ-ই।

সরেজমিনে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন আমাদের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। ছবি তুলেছেন অনিক খান। আজ পড়ুন ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি।  

ময়মনসিংহ: ময়মনসিংহ নগরীর সানকিপাড়া রেলক্রসিং থেকে জামালপুরগামী রেললাইনের ৫০০ গজের মধ্যে কোনো পাথর নেই। নাট-বল্টু বা হুক ও স্লিপার মাটিতে ঢেকে গেছে। খানিক সামনে এগোতেই এ চিত্র আরো ভয়াবহ। কাঠের স্লিপারগুলোর অবস্থাও বেশ নাজুক। কোথাও ধরেছে পচন। চুরি হয়ে গেছে ক্লিপ। অনেক জায়গায় অস্তিত্ব নেই নাট-বল্টুরও।  

নগরীর বাঘমারা রেলক্রসিং থেকে নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ রুটেও পাথর নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ স্থানেই হাওয়া নাট-বল্টু। একই রকম জীর্ণদশা ময়মনসিংহ-ঢাকা রুটের গফরগাঁও স্টেশন এলাকা থেকে আউটার সিগন্যালের মধ্যবর্তী প্রায় আড়াই কিলোমিটার এলাকা। যেন পাথরশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো রেললাইন। কোনো কোনো স্থানে স্লিপারের নিচ থেকে সরে যাচ্ছে মাটি।  

কাঠের স্লিপার পচে নড়বড়ে হয়ে গেছে, নাই হয়ে গেছে লাইনের সঙ্গে স্লিপারের ক্লিপও।  ছবি: অনিক খান ভয়াবহ এমন চিত্রই বলে দিচ্ছে ময়মনসিংহ-ঢাকা, ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহ-জামালপুর-দেওয়ানগঞ্জ বা ময়মনসিংহ-ভৈরব কিংবা ময়মনসিংহ-ঝারিয়া রেলপথে এক রকম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে রেল। ফলে যেকোনো সময়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কাও তাড়া করছে।  

শুধু তাই নয়, এসব লাইনে রেলের গতিও নেই। ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার গতিতে এসব রেলপথে চলে ট্রেন।  

রেলওয়ের ময়মনসিংহ প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ময়মনসিংহ-ঢাকা, ময়মনসিংহ-মোহনগঞ্জ, ময়মনসিংহ-দেওয়ানগঞ্জ বা ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথের মোট ২০২ কিলোমিটার ময়মনসিংহ প্রকৌশল বিভাগের অধীনে রয়েছে। কিন্তু পুরো লাইনটিই যেন জরাজীর্ণ।  

এ রেলপথেই বছরের পর বছর ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন। ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন স্টেশন থেকে নিত্যদিন ১৪ টি আন্তঃনগর, ১২টি মেইল, লোকাল ও ৮টি কমিউটারসহ মোট ৬৮টি ট্রেন চলাচল করে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর কলেজ রোড রেলক্রসিং থেকে মিন্টু কলেজ রেলক্রসিং পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার রেল সড়কে নামেমাত্র নাট-বল্টু রয়েছে। কোনো কোনো স্থানে রেললাইনের সঙ্গে স্লিপার আটকানোর ক্লিপ উধাও হয়ে গেছে। খানিক গতি নিয়ে ট্রেন চললে জয়েন্ট পয়েন্টগুলো ফাঁক হয়ে যায়। এসব লাইন মেরামত না করায় চরম দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।  

নগরীর সানকিপাড়া রেলক্রসিং এলাকার চায়ের দোকানি শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, রেললাইনের অনেক পয়েন্টে নাট-বল্টু আবার কোথাও ক্লিপ নেই। ফলে ট্রেন চলার সময় বিকট শব্দে আতঙ্ক তৈরি হয়। কিন্তু এসব নিয়ে কারো কোনো নজর নেই।  

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা রুটে নিয়মিত চলাচলকারী ট্রেনযাত্রী আব্দুস সামাদ বাংলানিউজকে বলেন, এ রেলপথে শত শত স্লিপার জরাজীর্ণ। অনেক স্লিপার ভাঙাচুরা। পাথরের বালাই নেই কোথাও কোথাও। ফলে এ পথে অনেক স্থানে হেলেদুলে ট্রেন চলে। কখন বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে সেই দুশ্চিন্তা নিয়ে দুরুদুরু বুকে ছুটতে হয় আমাদের, নিরাপদ মনে করে ট্রেনই বেছে নিই।  

জানা গেছে, নগরীর বাইরে গৌরীপুর রেল জংশন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের বাইরে রেলপথে ফিশপ্লেটে পর্যাপ্ত নাট-বল্টু নেই। প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন অনেক উচু। রেললাইনের স্লিপার মাটির নিচে চলে গেছে। অনেক স্থানে স্থানে হ্রাস পেয়েছে পাথরের সংখ্যাও। সংঘবদ্ধ চক্র এসব প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ চুরি করে বিক্রি করছে।  

ময়মনসিংহ-ভৈরব রেলপথের ঈশ্বরগঞ্জ অংশ পাথরবিহীন হয়ে পড়েছে। চুরি হয়ে গেছে নাট-বল্টু ও ক্লিপ। ফলে ঝুঁকির মধ্যে অব্যাহত রয়েছে ট্রেন চলাচল। স্থানীয়রা জরাজীর্ণ এসব রেললাইন সংস্কারের দাবি জানালেও এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাই চোখে পড়ে। নাট-বল্টু বা স্লিপার অকার্যকর স্থানে কাঁত হয়ে ট্রেন চলে।  

নগরীর অরক্ষিত রেলক্রসিং, পাথরবিহীন লাইন ঢেকে গেছে বালু ও মাটিতে।  ছবি: অনিক খান তবে রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, বছরের পুরোটা সময়েই রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলমান থাকে। কিন্তু স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, রক্ষণাবেক্ষণের নাম করে কাগজে-কলমে শুধু বিল-ভাউচার করে লুটপাট করা হয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। জোড়াতালির এমন সচল কাজের জন্যই একদিন বড় রকমের মাশুল গুণতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন রেলের যাত্রীরা।  

রেল সূত্র জানায়, সাধারণত নিয়ম হচ্ছে রেলপথে যন্ত্রাংশসমূহ ঠিকঠাক রাখা। ‍নিয়মিত তদারকি করা রেললাইন ঠিকঠাক আছে কি-না। কোনো যন্ত্রাংশ চুরি হলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই তা মেরামত করা। এসব দেখভালের জন্য রেলওয়ে পরিদর্শককে মাসে একবার লাইন পরিদর্শনের নিয়ম থাকলেও তিন থেকে চার মাসেও কারো দেখা মেলে না। ফলে রেলের দুঃখগাঁথা দেখার জন্য যেন নেই কেউ।  

রেললাইনের এই দুরাবস্থার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ রেলওয়ের ময়মনসিংহ অঞ্চলের সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলী সুকুমার সরকার বাংলানিউজকে বলেন, অনেক স্থানেই পাথর বা অন্যান্য যন্ত্রাংশ নেই। এসব স্থানে মালামালের রিকুইজিশন দেওয়া হয়েছে।  

‘পর্যায়ক্রমে সেখানে পাথর ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ স্থাপনের কাজ চলবে। মেইনটেনেন্স ফান্ডের অধীনে এসব কাজ করার জন্য একাধিক কর্মকর্তা তৎপর রয়েছেন। তারাই পর্যায়ক্রমে সব কাজ সম্পন্ন করবেন। ’ 

বাংলাদেশ সময়: ১১০৩ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১৯
এমএএএম/এমএ/ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।