ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘ছুরি নিয়ে আসামি কীভাবে এজলাসে ঢোকে?’

ইমতিয়াজ আহমেদ জিতু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৯
‘ছুরি নিয়ে আসামি কীভাবে এজলাসে ঢোকে?’

কুমিল্লা: ‘ছুরি নিয়ে আসামি কীভাবে বিচারকের এজলাসে ঢোকে?’ কুমিল্লায় আদালতে বিচার চলাকালে বিচারকের সামনে এক আসামির ছুরিকাঘাতে আরেক আসামি খুন হওয়ার পর এখন এই প্রশ্নই উঠেছে দেশজুড়ে। এ ঘটনায় বিস্মিত-স্তম্ভিত কুমিল্লাবাসী। তাদের প্রশ্ন, এজলাসে প্রবেশের আগে পুলিশ কি আসামিদের তল্লাশি করেনি? পুলিশের চোখ এড়িয়ে আসামি কীভাবে এতো বড় ছুরি নিয়ে এজলাসে প্রবেশ করলো? কুমিল্লার সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

সোমবার (১৫ জুলাই) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তৃতীয় আদালতের বিচারক ফাতেমা ফেরদৌসের আদালতে মনোহরগঞ্জ উপজেলার কান্দি গ্রামে ২০১৩ সালের ২৬ আগস্ট সংঘটিত আবদুল করিম হত্যা মামলায় (মামলা নং-১৩) আসামি আবুল হাসান (২৫) ও ফারুক হোসেন (২৭) হাজিরা দিতে আসেন। আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলার সময় ওই হত্যা মামলার আসামি আবুল হাসান হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে তার সহযোগী আসামি ফারুক হোসেনকে ছুরিকাঘাত করতে থাকেন।

ফারুক দৌঁড়ে বিচারকের খাস কামরায় গিয়ে আশ্রয় নিলেও হাসান দৌঁড়ে ওই কামরায় গিয়ে ফারুককে আবারও উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করেন। এতে ফারুক মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন। এসময় আদালতের পুলিশ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা হাসানকে ধরে ফেলেন।  

গুরুতর আহত ফারুককে প্রথমে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে ও পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালে নেওয়া হয়। কিন্তু কুমেকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।  

ফারুক মনোহরগঞ্জের অহিদ উল্লাহর ছেলে এবং হাসান লাকসাম উপজেলার ভোজপুর গ্রামের শহীদুল্লাহর ছেলে। দু’জন সম্পর্কে আপন মামাতো-ফুফাতো ভাই।

এ হত্যাকাণ্ড তদন্তে জেলা পুলিশ তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেনকে। অপর দুই সদস্য হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) তানভীর সালেহীন ইমন এবং ডিআইও-১ মাহবুব মোর্শেদ।

আদালতের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এমন নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ডে সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা। যেখানে মানুষের বিচার পাওয়ার একমাত্র আশ্রয়, সেখানেই মানুষের নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হওয়ার এ বর্বরোচিত নজির কুমিল্লাজুড়ে সমালোচনার ঝড় চলছে।

জেলার সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি বদরুল হুদা জেনু বাংলানিউজকে বলেন, ‘এটা খুবই নিন্দনীয় ও হতাশাজনক ঘটনা। আদালতের মতো একটি জায়গায় এমন ঘটনা ঘটবে তা আশা করা যায় না। আদালত মানুষের বিচার পাওয়ার একমাত্র ঠিকানা, আর সেখানেই মানুষ নিরাপত্তাহীন। তা কি ভাবা যায়? যদিও ঘটনাটি দুভার্গ্যবশত হয়েছে। তারপরও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সচেতন হওয়ার দরকার ছিল। এজলাসে ছোরা নিয়ে আসামি ঢুকবে, মানুষ খুন করবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। তাই ভবিষ্যতে যেন এমন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, সেদিকে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। ’

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী তাসনিম ফারিয়া বলেন, ‘আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না আদালতে বিচারকের সামনে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটবে। এটা খুবই উদ্বেগজনক ঘটনা। আদালতেও মানুষের নিরাপত্তা নেই। বিষয়টি খুবই হতাশার। ’

আইনজীবীরা বলছেন, আদালতের নিরাপত্তা বিধান করা পুলিশের দায়িত্ব। এজলাসের ভেতর কোনো প্রকার অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তারপরও এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এ ঘটনায় আমরা বিব্রত। আসামিরা কাস্টডিতে থাকলে এমন হওয়ার সুযোগ ছিল না। যেহেতু আসামিদ্বয় জামিনে ছিলেন, তারা আজ হাজিরা দিতে এসেছিলেন, তাই এমন ঘটেছে।

আইনজীবী আনোয়ারুল হক বলেন, ‘আদালত হলো মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার জায়গা। সেখানে যদি কেউ অস্ত্র নিয়ে ঢুকে মানুষ হত্যা করে, তাহলে মানুষ কোথায় বিচারপ্রার্থী হবে? এটা খুবই হতাশাজনক ঘটনা। তাই পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আধুনিকায়ন পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত। ’

এ বিষয়ে আদালতের পুলিশ পরিদর্শক সুব্রত ব্যানার্জি বাংলানিউজকে বলেন, ‘আদালতের ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। এটা অবিশ্বাস্য। এতে পুলিশের অবহেলা ছিল না। গেইট থেকে শুরু করে সব জায়গায় পুলিশ যথাসাধ্য তাদের কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৪-৫ হাজার মানুষ আদালতে আসে। পুলিশ প্রতিদিন তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছে। এমন ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাতীত ছিল। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আসামি হাসান পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হাসান দাবি করেছে, ফারুকের কারণে সে এই হত্যা (আবদুল করিম) মামলার আসামি হয়েছে। আদালতে আসার পর তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। তাই ক্ষোভ থেকে এ ঘটনা ঘটিয়েছে হাসান। ’

কুমিল্লার পুলিশ সুপার (এসপি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘এতোটা নিরাপত্তার মাঝেও আসামি ছুরি নিয়ে কীভাবে আদালতে ভেতরে প্রবেশ করলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং দায়িত্বরত পুলিশের অবহেলা থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ০১২২ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৯
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।