ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সামান্য ঠাঁই পেতে বাঁধে ছুটছেন বানভাসিরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১১ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৯
সামান্য ঠাঁই পেতে বাঁধে ছুটছেন বানভাসিরা

বগুড়া: কয়েক সপ্তাহ আগেও যমুনা শান্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানের চিত্রটা একেবারে ভিন্ন। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে ফুলে ফেঁপে উঠেছে যমুনার পেট! 

সোমবার (১৫ জুলাই) বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় যমুনা পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া পানি বাড়া এখনো অব্যাহত রয়েছে।


 
আর তাতেই হিংস্র হয়ে উঠছে যমুনা। শান্ত যমুনা অশান্ত হয়ে পড়ায়, চারপাশে পানি ছড়িয়ে পড়ছে। দিন যাচ্ছে, আর নতুন নতুন গ্রামে পানি ঢুকছে। ফলে প্রতিনিয়ত ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে নিত্য নতুন পরিবার। বাধ্য হয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
 
তাদের একজন জমিলা বিবি। এক ছেলে ও ‍দুই মেয়ে নিয়ে তার সংসার। বেশ আগেই মারা গেছেন স্বামী ফরিদুল ইসলাম। বাড়ি সারিয়াকান্দি উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের কুতুবপুর গ্রামে। যমুনার হিংস্র থাবায় এই নারী এ পর্যন্ত পাঁচবার স্থান ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। যমুনা গিলে ফেলেছে তার বসতভিটা।
 
বর্তমানে তার বসতভিটা অর্ধেক পানিতে নিমজ্জিত। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে করে যতোটুকু পেরেছেন, তাই নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। আর বাঁধে কতোদিন থাকতে হবে জানা নেই জমিলা বিবির।  যমুনার পানি বাড়ায় নিরাপদ আশ্রয় বাঁধে আসবাবপত্র নিয়ে ছুটছেন মানুষ।  ছবি: বাংলানিউজঅতীত অভিজ্ঞতা থেকে এই নারী বাংলানিউজকে বলেন, অন্তত তিন মাস বাঁধেই জীবন কাটাতে হবে তার মতো বন্যায় বসতভিটা হারিয়ে ফেলা মানুষদের।
 
সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনার ডান পাশে নির্মিত কর্ণিবাড়ি-কুতুবপুর-চন্দনবাইশা-রহদহ-কামলাপুর আট কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ।  

এদিকে, ধুনট উপজেলার যমুনা তীরবর্তী সাত কিলোমিটার সহড়াবাড়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। বানভাসি মানুষগুলো যার যার মতো করে যা পারছেন তাই নিয়ে বাঁধে এসে আশ্রয় গড়ে তুলছেন।
 
সরেজিমনে দেখা যায়, চিত্রটা প্রত্যেক বছরের মতোই। বন্যা এলে ক্ষতিগ্রস্তদের সবাইকে নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য ছুটতে হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কারণে ইতোমধ্যে অনেক পরিবার গৃহহারা হয়ে পড়েছে।
 
তারাই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের দু’পাশ দিয়ে ঝুপড়ি ঘরে বানিয়ে চলেছেন। বাঁশ, কাঠের বাটাম, পলিথিন, দড়ি, লোহা, টিনসহ আনুসাঙ্গিক সামগ্রী ব্যবহার করে রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসব ঘর তৈরি করছেন বানভাসি মানুষগুলো।
 
ঘরগুলো পরিসরে বেশ ছোট। এসব ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরেই বানের কয়েক মাস বানভাসিদের জীবন কাটাতে হবে। এক ঘরেই সবাইকে ঠাসাঠাসি করে বসবাস করতে হবে। আবার কেউ কেউ এসব ঘরেই গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হন। সেখানে প্রসাব-পায়খানার কোনো ব্যবস্থা থাকে না। বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দেয়। এসব মেনেই বাধ্য হয়ে তারা বানের কয়েক মাস বাঁধে কাটিয়ে দেন কষ্টের দিন-রাত।
 
এদের মধ্যে অনেকেই ঘর নির্মাণের কাজ গুটিয়ে ফেলেছেন। আবার অনেকেই নতুন নতুন ঘর নির্মাণ করছেন। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যমুনার পানি। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বসতবাড়িতে সেই পানি ঢুকছে। এসব পরিবারের মানুষ আশ্রয় নিতে বাঁধে চলে আসছেন। নির্মাণ করছেন সামান্য মাথা গোঁজার ঠাঁই। বাঁধের পশ্চিম পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে এসব ঘর গড়ে তোলা হচ্ছে।
 
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া জসিম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ জীবন যমুনার সঙ্গে সংগ্রাম করে চলেছি। কিন্তু বয়স তো থেমে নেই। শরীরটা আগের মতো চলতে চায় না। কিন্তু যমুনার আশপাশে বসবাস করলে এমন বাস্তবতা না মেনে কোনো উপায় নেই। নইলে যমুনাকে চিরবিদায় জানাতে হবে। অনেক দূরে চলে যেতে হবে। কিন্তু সেই সামর্থ নেই। তাই যমুনার ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেই হয়তো বাকি জীবনটা পারি দিতে হবে।  
 
বাঁধে আশ্রয় নিতে আসা জহুরা বেগম নামে এক নারী বাংলানিউজকে বলেন, অভাবের সংসার। সংসারে সারা বছর ঘাটতি লেগেই থাকে। কাজ করলে তবেই পেটে ভাত যায়। নইলে উপোস থাকতে হয়। এরমধ্যে আবার যমুনার তাণ্ডব শুরু হয়েছে। না জানি ক’দিন এই মরণ জ্বালা সহ্য করতে হয়।
 
বাঁধে আশ্রয় নেওয়া ও নিতে আসা এসব ব্যক্তিরা জানান, সাত-আটদিনের ব্যবধানে তাদের বসতবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকেছে। ক্রমেই পানি বেড়েই চলছে। পানিতে ভিজে বিপুল সংখ্যক মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যারা দ্রুত বাঁধে ঠাঁই নিয়েছেন, তারা ক্ষতি অনেকটা কমাতে পেরেছেন।
 
এ অবস্থায় অনেক মানুষের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় এই দুই উপজেলাসহ পাশের সোনতলা উপজেলার বানভাসি মানুষগুলো জীবন বাঁচানোর সংগ্রামে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উঁচু এলাকায় আশ্রয় নিতে ব্যস্ত বলেও জানান বানভাসি এসব মানুষগুলো।  
 
বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৯
এমবিএইচ/আরবি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।