ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মেধায় পুলিশের চাকরি পেলো দিনমজুরের ছেলে-কৃষকের মেয়ে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৯
মেধায় পুলিশের চাকরি পেলো দিনমজুরের ছেলে-কৃষকের মেয়ে চাকরিপ্রাপ্তদের সঙ্গে সেলফি তুলছেন বগুড়া জেলার এসপি আলী আশরাফ ভূঞা। ছবি: আরিফ জাহান

বগুড়া: তখন রাত ১১টা। বগুড়া পুলিশ লাইন্স অডিটোরিয়ামে পুলিশ ট্রেইনি রিক্রুটিং কনস্টেবল (টিআরসি) পদে নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করছিলেন জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) আলী আশরাফ ভূঞা।

মঞ্চের সামনে কিছুটা ফাঁকেই বসেছিলেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। মাইকে উত্তীর্ণদের রোল নম্বর ও নাম ঘোষণা করছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

চূড়ান্ত ফলে উত্তীর্ণরা নাম শোনার পরপরই উত্তর দিচ্ছিলেন ‘ইয়েস স্যার’। আর চূড়ান্ত ঘোষণায় নিজের নামটি শোনার পরপর অনেকেই আনন্দ অশ্রুতে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ছিলেন। অশ্রু ভেজা চোখেই অনেককে উল্লাস করতে দেখা যায় নিজের নামটি শোনার পর। এ তালিকায় উত্তীর্ণ ছেলে-মেয়েদের দৃশ্যটা ছিল একই ধরনের। অবশ্য অনুভূতি ছিল একেকজনের একেক ধরনের।

তাদেরই একজন বগুড়া কাহালু উপজেলার বান্দাইখারা গ্রামের কৃষক ফেরদৌস রহমানের মেয়ে ফারহানা আক্তার। বাবা পেশায় একজন কৃষক। অভাবী সংসারে মেয়েটি টিউশনি করে নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে নেন। হতাশা থাকলেও দমিয়ে যাননি ফারহানা। অনেক কষ্টের সঙ্গে লড়াই করে এবার এইচএসসি পরীক্ষাও দেন। চাকরিপ্রাপ্তরা।  ছবি: আরিফ জাহানসঙ্গে ভাবতে থাকেন চাকরির ভাবনা। কারণ অভাবী সংসারের হাল তাকে ধরতেই হবে। কিন্তু কীভাবে? টাকা ছাড়া কি চাকরির চিন্তা করা যায়? তাও আবার একটি সরকারি চাকরি ছিল তার প্রত্যাশা। হ্যাঁ ফারহানা আক্তার নানা মাধ্যমে জানতে পারেন পুলিশ কনস্টেবলের নিয়োগের কথা। তাও নাকি কোনো টাকা পয়সা ছাড়াই চাকরি পাওয়া যাবে?

কথাটি শোনার পর অবশ্য তার মনে বিশ্বাস ধরেনি। তবু চেষ্টা করতে দোষ কি। যেই ভাবনা সেই ৩ টাকায় ফরম কিনে সঙ্গে ১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট করে কনস্টেবল পদে আবেদন করেন। শেষ অবধি তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। ঘুষ ছাড়াই পেয়ে যান প্রত্যাশী সেই চাকরি। চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণায় নিজের নামটি শোনার পর আনন্দে আপ্লুত হয়ে পড়েন ফারহানা আক্তার।

কনস্টেবল পদে উত্তীর্ণদের তালিকায় ফারহানা আক্তারের মতো অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তান ছিলেন।

শিবগঞ্জ উপজেলার শামীম, এরশাদুল, দুপচাঁচিয়া উপজেলার রিফাহ হোসেন, বগুড়া সদর উপজেলার বিথি খাতুন, নন্দীগ্রাম উপজেলার রাবেয়াসহ অনেকেই এবার কনস্টেবল পদে চাকরি পেয়েছেন। তাও আবার ঘুষ ও প্রয়োজন হয়নি তদবিরের। মাত্র ১০৩ টাকা ব্যয় করে এরা পেয়ে যান প্রত্যাশী পুলিশের চাকরি।

বুধবার (১০ জুলাই) দিনগত রাতে ১১টা থেকে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন জেলার এসপি আলী আশরাফ ভূঞা। ফলাফল ঘোষণার পর কনস্টেবল পদে উত্তীর্ণদের অনেকেই এসপির সঙ্গে সেলফিতে মেতে ওঠেন।

দিনমজুর মোখলেছার আলীর ছেলে ইউসুফ আলী। বাড়ি গাবতলী উপজেলায়। চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার নিজের নামটি শোনার পর তার চোখ অশ্রুতে ভরে যায়।

দিনমজুরের ছেলে ইউসুফ আলী পুলিশের চাকরি পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, আমার পরিবারে বাবা ছাড়া উপার্জনক্ষম কোনো ব্যক্তি নেই। তাই একটা চাকরির খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ঘুষ ছাড়া কোথায় চাকরি পাবো, এমন চিন্তা মাথা থেকে দূর হচ্ছিল না। তবে কনস্টেবল পদে আবেদন করার পর নানা মাধ্যমে জানতে পারছিলাম এবার পুলিশে চাকরি পেতে কোনো ঘুষ বা তদবির লাগবে না। বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবশেষে সেটাই সত্যি হলো। পেয়ে গেলাম চাকরি।

তার ভাষ্য, সত্যের জয় হলো, মিথ্যার পরাজয় ঘটলো। ঘুষ-তদবির ছাড়াই সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জেলায় ২৩৯ জনকে কনস্টেবল পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এজন্য প্রত্যেককে মাত্র ১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট ও নির্ধারিত ফরমের জন্য ৩ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। আর চাকরিপ্রাপ্তদের সিংহভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এবার জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রার্থী পুলিশের কনস্টেবল পদে নিয়োগে অংশ নেন। মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন ৬ হাজার ২১ জন। তাদের মধ্য থেকে শারীরিক যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ভিত্তিতে ৬২১ জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত করা হয়। পরে তাদের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। সেখান থেকে ১২৫জন পুরুষ, ৭০জন নারী ও অন্যান্য কোটায় ৪৪ জনসহ মোট ২৩৯ জনকে চূড়ান্তভাবে চাকরির জন্য মনোনীত করা হয়। এছাড়া ১০ জনকে অপেক্ষমানের তালিকায় রাখা হয়েছে। উত্তীর্ণদের আগামী ১৩ জুলাই মেডিক্যাল পরীক্ষায় অংশ নিতে বলা হয়েছে।

জেলার এসপি আলী আশরাফ ভূঞা ফলাফল ঘোষণার পর বলেন, এবারের মতো শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ আগে কখনো দেখিনি। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে নিয়োগ পরীক্ষার আগে থেকে আমরা সতর্ক ছিলাম। দালালরা যাতে প্রার্থীদের প্রতারিত করতে না পারে, সেজন্য গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল মাঠে কাজ করেছে। এরপরও যারা দালালদের চাকরি লাভের আশায় টাকা দিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে অভিযোগ পেলে টাকা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন ওই এসপি।

তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছে। নারী-পুরুষ সাধারণ মেধা কোটা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা, পোষ্য ও এতিম কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত সবাই মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। এভাবে গত জুলাই থেকে পুলিশ টিআরসি পদে নিয়োগের কার্যক্রম গেলো বুধবার (১০ জুলাই) দিনগত রাতে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ১১, ২০১৯
এমবিএইচ/এএটি

 

 

 

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।