ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রেলে দুর্নীতি বন্ধসহ দুদকের ১৫ সুপারিশ 

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৩৯ ঘণ্টা, জুলাই ২, ২০১৯
রেলে দুর্নীতি বন্ধসহ দুদকের ১৫ সুপারিশ 

ঢাকা: কোচ-ইঞ্জিন ক্রয়ে দুর্নীতিসহ ১০ উৎস চিহ্নিত করে রেলের দুর্নীতি বন্ধে ১৫ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

মঙ্গলবার (০২ জুলাই) সকালে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের কাছে এ প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান কমিশনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে গঠিত ‘বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক টিম’ এর পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন।

এসময় দুদক কমিশনার বলেন, দুদক ২০১৭ সালে দেশের ২৫টি মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান আইন, বিধি-বিধানের পদ্ধতিগত ত্রুটি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব এবং জনবল সংকটের কারণে যেসব দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি হয় তার উৎস চিহ্নিত করে তা বন্ধে বা প্রতিরোধে পৃথক পৃথক ২৫টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। এ পর্যন্ত কমিশন ১২টি প্রতিবেদন এরইমধ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করেছে।  

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনটি ১৩তম প্রতিবেদন জানিয়ে দুদক কমিশনার বলেন, এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির ১০টি উৎস চিহ্নিত করে তা নিরসনে ১৫টি সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ প্রতিবেদন কোনো বিশেষজ্ঞ মতামত সংবলিত প্রতিবেদন নয়, তবে এটি কমিশনের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টিমের প্রতিবেদন। টিম বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার বলেন, দুদকের নজরদারি কেবল রেলপথ মন্ত্রণালয়ে নয়, দেশের সর্বত্রই দুর্নীতি প্রতিরোধ ও দমনে নজরদারি রয়েছে। দুর্নীতির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি উল্লেখ করে দুদক কমিশনার বলেন, কমিশন দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে নিরলসভাবে কাজ করছে। এক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই। দেশের বিকাশমান অর্থনৈতিক গতিধারাকে অব্যাহত রাখতে হলে দুর্নীতি দমন, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।

প্রতিবেদন বলা হয়, দুর্নীতির উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চল) চট্টগ্রাম এবং (পশ্চিমাঞ্চল) রাজশাহীর অধীনে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি লিজ/ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে, রেলওয়ের অনেক জলাশয়/পুকুর নিয়ম বহির্ভূতভাবে লিজ দেওয়া হয়। যার ফলে সরকারি রাজস্ব যথাযথভাবে আদায় হয় না। রেলওয়ের জায়গায় রেল সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে স্থাপনা নির্মাণ করতে দেওয়া হয় এবং এ থেকে রেলওয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান  হয়ে থাকেন মর্মে অভিযোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা, যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাবে রেল বিভাগের শত শত একর ভূমি বেদখল হয়ে আছে। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রেলওয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীরা অবৈধভাবে দখল করে বাসা বাড়িসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।  

রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ, ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট (ডিএমইউ) ক্রয়/সংগ্রহসহ অন্যান্য ক্রয়/ সংগ্রহ কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন সেকশনের স্টেশনের সিগন্যালিং ব্যবস্থা পুনর্বাসন ও আধুনিকীকরণ কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ডাবল লাইন, সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ রেলওয়েতে ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত কাজে দুর্নীতি হয়ে থাকে।  

বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিএস/কারখানা সৈয়দপুর, নীলফামারী; বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চল, পাকশী; বাংলাদেশ রেলওয়ে, ঢাকা; বাংলাদেশ রেলওয়ে, লালমনিরহাট; পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এবং এমজি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন নিলামে যন্ত্রাংশ বিক্রি প্রক্রিয়ায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে যথাযথ উপাদান লাইনে না দেওয়া, যন্ত্রাংশ সংস্থাপন যথাযথভাবে না করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়ে থাকে।

রেলওয়ের অধীনে ওয়ার্কশপগুলো কার্যকরী না করে আমদানির মাধ্যমে বিভিন্নভাবে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। এছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ে স্লিপার ফ্যাক্টরি অকার্যকর রেখে সরকারের আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়ে থাকে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।

রেলওয়ের টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে কালোবাজারি হয়ে থাকে এবং এ কালোবাজারিতে রেলওয়ের কর্মচারীরা জড়িত থাকেন। কতিপয় দালাল রেলওয়ের কর্মচারীদের সহযোগিতায় আন্তঃনগর ট্রেনের বেশি সংখ্যক টিকিট ক্রয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে, যার কারণে জনগণকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

যাত্রীবাহী ট্রেন ইজারা দিতে দুর্নীতি হয়ে থাকে এবং যাত্রীবাহী ট্রেনে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কাছে থেকে জনসাধারণ কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।

আন্তঃনগর ট্রেনসহ অন্যান্য ট্রেনে সরবরাহকৃত ও বিক্রিত খাবারের মান নিম্নমানের ও জনস্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক নয় মর্মে জানা যায়। এছাড়া ট্রেনে সরবরাহকৃত খাবারের দামও তুলনামূলকভাবে বেশি। এক্ষেত্রে যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে।  

এদিকে দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রাতিষ্ঠানিক টিমের সুপারিশমালার মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগে ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা নেওয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা।

বিভিন্ন ধরনের ক্রয়ে প্রতিযোগিতামূলক প্রকাশ্য/ই-টেন্ডারিং, দরপত্র আহ্বান থেকে শুরু করে কার্যাদেশ প্রদান ও প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞ সিনিয়র কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা/কর্মচারীদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। টেন্ডার প্রক্রিয়ায় পিপিআর অনুযায়ী পরামর্শক নিয়োগে বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে (বুয়েট/রুয়েট/ চুয়েট/ কুয়েট/ ডুয়েট ইত্যাদি) সম্পৃক্ত করা যেতে পারে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের কোয়ার্টার/বাসভবন/অফিস স্থাপনার সম্পত্তি ডিজিটাল ডাটা এন্ট্রির মাধ্যমে তালিকা প্রস্তুত করাসহ অবৈধভাবে দখলকৃত সম্পত্তি নিজস্ব তত্ত্বাবধানে আনতে হবে। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ ও দক্ষ আইনজীবী প্যানেল গঠন করে আদালতে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে এবং বাংলাদেশ রেলওয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ওয়ার্কশপ ও স্লিপার ফ্যাক্টরিগুলো সচল এবং কার্যকরী করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

কোচ আমদানি নিরুৎসাহিত করে রেলওয়ের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে কোচ নির্মাণ করার সক্ষমতা সৃষ্টি করা যেতে পারে।

মনোপলি বা একচেটিয়া ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পিপিএ এবং পিপিআর অনুসরণ করা যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠানের (যেমন-বুয়েট/চুয়েট/কুয়েট/রুয়েট/ডুয়েট) মাধ্যমে নতুন লাইন নির্মাণ/সংস্কার কাজ তদারকির ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
        
অডিট কার্যক্রম জোরদার করা এবং অডিট আপত্তি জরুরিভাবে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

পিপিআর অনুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির মাধ্যমে রেলওয়ের পুরনো মালামাল (লৌহজাত) বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

টিকিট কালোবাজারিরোধে টিকিট বিক্রিতে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, যাতে কোনো অবস্থাতেই টিকিট কালোবাজারি না হয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠাকে মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

আধুনিকায়নের মাধ্যমে যাত্রীসেবা বৃদ্ধি করা, বিশেষ করে নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেন চলাচল নিশ্চিতকরণ; যাত্রী নিরাপত্তা ও মালামাল পরিবহনে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত বগি, লোকোমোটিভ ও ওয়াগন ক্রয়সহ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যবস্থার উন্নয়ন করা প্রয়োজন।  

আন্তঃনগর ট্রেনসহ অন্যান্য ট্রেনে সরবরাহকৃত/বিক্রিকৃত খাবার মানসম্মত বা স্বাস্থ্যসম্মত কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ট্রেনের পরিচালক (গার্ড) এর নেতৃত্বে একটি যথাযথ তদারকি ব্যবস্থা থাকা দরকার। এছাড়া, খাবারের দামও যৌক্তিক নির্ধারণের জন্য অর্থাৎ কোন খাবারের কত দাম তা কেবল মুনাফার কথা চিন্তা না করে যাত্রীরা যাতে যৌক্তিক দামে খাবার ক্রয় করতে পারে সে বিষয়েও যথাযথ তদারকি ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার।  

বাংলাদেশ রেলওয়ের সব কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় (অটোমেশন) পদ্ধতির আওতায় আনা যেতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৭ ঘণ্টা, জুলাই ০২, ২০১৯/আপডেট: ১৪৫৩ ঘণ্টা
এসএমএকে/এমএ/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad