ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

নরসিংদীকে নতুনভাবে পরিচিত করছে ‘কদরহীন’ লটকন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৮ ঘণ্টা, জুলাই ১, ২০১৯
নরসিংদীকে নতুনভাবে পরিচিত করছে ‘কদরহীন’ লটকন লটকনে ভরে গেছে গাছ। ছবি: বাংলানিউজ

নরসিংদী: এক সময়ের ‘কদরহীন’ লটকন এখন বর্ষা মৌসুমের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল। এ ফল এতোটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে মৌসুম শুরু হতেই এর স্বাদ নিতে অপেক্ষায় থাকেন দেশবাসী। শুধু তাই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ ফলের স্বাদ ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশে। যার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। 

লটকনের জন্য বিখ্যাত নরসিংদীর বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা ও পলাশ উপজেলার বাগানগুলো এখন ‘লটকনময়’। জেলার উৎপাদিত লটকন আকারে বড়, দেখতে হলদে, মসৃণ, আর স্বাদেও সুমিষ্ট।

যা এই অঞ্চলের কৃষকদের কাছে যেকোনো কৃষি ফলনের চেয়ে এখন বেশি লাভজনক। আর তাই তাঁত ও কলার নরসিংদীকে নতুনভাবে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে ‘লটকনের রাজ্য’ হিসেবে।

নরসিংদীর পাশাপাশি সিলেট, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও গাজীপুর জেলায়ও লটকনের চাষ হচ্ছে। অঞ্চলভিত্তিক মৌসুমি এ ফলের বেশ কিছু স্থানীয় নাম রয়েছে। চট্টগ্রামে এর নাম হাড়ফাটা, সিলেটবাসী চেনেন ডুবি নামে, ময়মনসিংহে বলে কানাইজু। আঙুরের মতো থোকায় থোকায় ধরে বলে ইংরেজিতে এর নাম  Burmese grap । বৈজ্ঞানিক নাম  Baccaurea sapida ।

লটকনের স্বাদ অম্লমধুর, পুষ্টিমান প্রচুর। লটকনে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি-২, ভিটামিন-সি রয়েছে। এছাড়া ফলটি ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আমিষ, স্নেহ, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। আমাদের দেহের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন চারটি লটকনই সে চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। লটকনের ভেষজগুণও রয়েছে। এটি অত্যধিক তৃষ্ণা নিবারণ ও বমিভাব দূর করতে কার্যকর। শুকনো পাতার গুড়ো ডায়রিয়া নিরাময় ও মানসিক চাপ কমায়। লটকনে ভরে গেছে গাছ।  ছবি: বাংলানিউজঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর মরজাল বাসস্ট্যান্ডের উত্তরে বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রাম। মরজাল বাসস্ট্যান্ড থেকে আধাকিলোমিটার লাখপুরের দিকে এগোলে ছায়াঘেরা সড়কের পাশ ঘেঁষে চোখে পড়বে লটকনের রাজ্য। কাঁঠাল আর জলপাই বাগানের দৃশ্য বাড়তি তৃপ্তির খোড়াক। গাছের আড়াল থেকে ভেসে আসা ঘুঘু ও চৈতার বউ পাখির সুরেলা কণ্ঠ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। চোখের সামনে দিয়ে যখন তখন দুধপাখিসহ বিভিন্ন পাখির এগাছ থেকে ওগাছে উড়ে যাওয়ার দৃশ্যে বিমোহিত না হওয়ার সুযোগ নেই।  

কম জনবসতির এই এলাকার অধিকাংশ গাছ গোড়ালি থেকে উপরের অংশের শাখা-প্রশাখায় লটকনে জড়িয়ে আছে। দেখতে মনে হয় যেন পুরো গাছে লটকনের ফুল ফুটছে। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে গাছে পাকা লটকন দেখে জিভে জল এসে যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী শিবপুর, রায়পুরা ও পলাশ উপজেলার বিভিন্ন গ্রামও তার ব্যতিক্রম নয়।

এলাকাবাসী ও কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উঁচু আর লালমাটির টিলা লটকন চাষের জন্য উপযোগী ভূমি। লটকন চাষে জটিলতা নেই, খরচ কম। রোপণের তিন বছরের মধ্যে ফলন আসে। ফল দেয় টানা বিশ থেকে ত্রিশ বছর। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০ দিন আগে গাছপ্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়।

পাশাপাশি লটকনের বাজারজাত নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় বাগান থেকে কিনে নেন। বাগান কেনার পদ্ধতিও চমৎকার। প্রথমে বাগানের মালিকের কাছ থেকে শিডিউল কিনে দর বসিয়ে জমা দিতে হয়। নিয়ম মাফিক সর্বোচ্চ দরদাতার কাছে বাগান বিক্রি করেন চাষিরা। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে পাইকারি বাজারে বিক্রি করেন। প্রকারভেদে মণ প্রতি দাম উঠে দুই হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা। যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ৬০ টাকা থেকে শুরু করে দেড়শ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালোমানের লটকন মধ্যপ্রাচ্য, লন্ডন ও ইউরোপে রপ্তানি করা হয়।

বেলাব উপজেলার আমলাব ইউনিয়নের লাখপুর গ্রামের লটকন চাষি নাসির উদ্দিন জানান, এই এলাকার মানুষের কাছে লটকন এখন অন্যতম অর্থকরী ফসল। অন্যান্য ফসলের তুলনায় কয়েকগুণ লাভ বেশি হওয়ায় লটকন চাষে ঝুঁকে পড়ছেন কৃষকরা। এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। তবে গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা কম। তবুও আমি ৫ বিঘা জমির লটকন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা বিক্রি হবে বলে আশা করছি।

নরসিংদী থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে পাইকারি লটকন বিক্রি করেন ফারুক মিয়া। তিনি জানান, নরসিংদীর লটকন দেখতে বড় ও খেতে সুস্বাদু হওয়ায় ঢাকার বাজারে এর চাহিদা ব্যাপক। প্রতিদিন এ বাজার থেকে তিনি ৩০ থেকে ৪০ মণ লটকন কিনছেন। জুনের প্রথম দিক থেকে শুরু হওয়া এ লটকনের বাজার চলবে আগস্ট পর্যন্ত।

নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শোভন কুমার ধর বলেন, এ বছর জেলার বেলাব, শিবপুর, রায়পুরা ও পলাশ উপজেলার প্রায় ১ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে লটকনের আবাদ করা হয়েছে। জেলার উৎপাদিত লটকন আকারে বড় ও স্বাদে সুমিষ্ট হওয়ায় দেশের বাজারের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এর ফলে প্রতি বছর জেলায় লটকনের আবাদ বাড়ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, জুলাই ০১, ২০১৯
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।