বুধবার (২৬ জুন) রাত ৮টায় শহরের ঘোড়াদিয়া শ্মশানে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।
চোখের জলে বুক ভিজিয়ে ফুলনকে সমাধিস্থ করেন বাবা যোগেন্দ্র বর্মণ ও বড় ভাই সুমন বর্মণসহ আত্মীয়-স্বজনরা।
টানা ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানে ফুলন বর্মণ। বুধবার ভোর ৬টায় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ফুলনের মৃত্যুর খবরে শোকের ছায়া নেমে আসে পুরো এলাকায়।
এদিকে বুধবার বিকেল ৫টায় ফুলনের মরদেহ বীরপুরে তার নিজ বাড়িতে পৌঁছালে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ফুলনের আত্মীয়-স্বজনদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠে। একনজর ফুলনকে দেখার জন্য এলাকাবাসী ও তার সহপাঠীরা বাড়িতে ভিড় জমায়। তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।
নরসিংদী পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার একেএম ফজলুর হক লিটন বলেন, ফুলনের গায়ে আগুন দেয়া একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনা। এ ঘটনার জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। যাতে এরকম ঘটনা ঘটানোর সাহস আর কেউ না পায়।
ফুলনের বাবা যোগেন্দ্র বর্মণ বলেন, আগুনে ফুলনের শরীরের ২১ শতাংশ পুড়ে যায়। কিন্তু মুখে কেরোসিন ঢালার কারণে ফুলনের শ্বাসনালীতে সমস্যা হয়ে যায়। যার কারণে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। এজন্য গত বৃহস্পতিবার ফুলনের অপারেশন করা হয়। এর পর থেকে ফুলন ভালোই ছিলো। কিন্তু গতকাল থেকে তার বমি হচ্ছিলো ও শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিলো। ডাক্তাররা তাকে সুস্থ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সে ভোরে মারা যায়।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের উপ পরিদর্শক (এসআই) আবদুল গাফফার বলেন, দগ্ধ ফুলন মারা যাওয়ায় আগের মামলাটি হত্যা মামলায় রুপান্তরিত হবে। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ জন সরাসরি এ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা আদালতে স্বীকার করেছে।
গত ১৩ জুন (বৃহস্পতিবার) রাত সাড়ে ৮টার দিকে শহরের বীরপুরে কলেজছাত্রী ফুলন বর্মণের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় নিহত ফুলনের বাবা যোগেন্দ্র বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা দুই জনকে আসামি করে সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত ভার পড়ে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডিবির উপ-পরিদর্শক আব্দুল গাফফারের নেতৃত্বে অভিযানে নামে পুলিশ। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সঞ্জিবসহ ৪ জনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবি করে।
পরে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ২০ জুন (বৃহস্পতিবার) রাতে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে রাজু সূত্রধর নামে একজনকে শহরের শিক্ষা চত্বর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এসময় পুলিশের কাছে আগুন দেওয়ার কথা স্বীকার করেন রাজু। রাজুর দেওয়া তথ্য মতে ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষ ও আনন্দকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
পরে গ্রেফতার হওয়া রাজু ২১ জুন (শুক্রবার) বিকেলে নরসিংদীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শারমিন আক্তার পিংকীর আদালতে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এরপর শনিবার বিকেলে কলেজছাত্রী ফুলনের ফুফাতো ভাই ভবতোষ বর্মণ নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহিনা আক্তারের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে রাজু ও ভবতোষ উল্লেখ করেন, ফুলনের ফুপাত ভাই ভবতোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাজু সূত্রধর ও আনন্দ বর্মণ। ফুলনের বাবা যোগেন্দ্রের সঙ্গে প্রতিবেশী সুখ লাল ও হিরা লালের সঙ্গে বাড়ির জমি সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে এলাকায় সালিশ দরবার হয়েছে।
ঘটনার দুই দিন আগে ১১ জুন (মঙ্গলবার) ভবতোষ ও তার মামীর (ফুলনের মা) সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয় প্রতিবেশী সুখ লালের। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ফুলনের মা বলেন, এখানে থাকবো না। দরকার হয় জমি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাবো। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ফুলনের শরীরে আগুন দিয়ে প্রতিবেশীকে মামলায় ফাঁসানোর পরিকল্পনা করে কলেজছাত্রী ফুলনের ভাই ভবতোষ। ঘটনার দিন ভবতোষ তার বন্ধু রাজু সূত্রধর ও আনন্দ বর্মণকে নিয়ে বীরপুর রেললাইনে বসে পরিকল্পনা করে।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ফুলন কেক নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে রাজু ফুলনের মুখ চেপে ধরে আর আনন্দ মাথায় ও শরীরে কেরোসিন ঢালে। আর ভবতোষ দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেওয়ার পর ভবতোষ, আনন্দ একদিক দিয়ে ও রাজু অন্যদিক দিক দিয়ে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
বাংলাদেশ সময়: ০৪২৪ ঘণ্টা, জুন ২৭, ২০১৯
আরএ