ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দেশসেরা প্রধান শিক্ষক শাহনাজের অদম্য পথচলা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০৫ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯
দেশসেরা প্রধান শিক্ষক শাহনাজের অদম্য পথচলা

কিশোরগঞ্জ: ছোটবেলা থেকেই আদর্শ শিক্ষক হওয়া লক্ষ্য ছিল শাহনাজ কবীরের। নিজের ভেতরের সেই অদম্য ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে হয়েছেন দেশসেরা প্রধান শিক্ষক। ছোটবেলায় শিক্ষক হওয়ার প্রেরণাটা নিয়েছিলেন তার শিক্ষক দাদা থেকে। 

সেই প্রেরণাই আজ তাকে নিয়ে এসেছে সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে। এতো কিছুর মধ্যেও এ দেশসেরা প্রধান শিক্ষককে যুদ্ধ করতে হয়েছে মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে।

তবে দেশ-বিদেশে সফল চিকিৎসায় জয়ী হয়েছেন তিনি।  তিনি ‘ক্যান্সার ও ভালোবাসা’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছেন।

শাহনাজ কবীরের দীর্ঘ পথচলার কথা জানতে তার কর্মস্থল এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সরাসরি হাজির হয়েছিলো বাংলানিউজ। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে দেশসেরা ‘প্রধান শিক্ষক’ হয়ে ওঠার অন্যরকম গল্প।  

বাংলানিউজ: আপনি তো এখন দেশসেরা প্রধান শিক্ষক। আপনার অনুভূতি কেমন?

শাহনাজ কবীর: খুব ভালো লাগছে। তবে সেই সঙ্গে দায়িত্ববোধও বেড়ে গেলো।  

বাংলানিউজ: শিক্ষকতা পেশায় আসার ইচ্ছেটা কিভাবে হলো? 

শাহনাজ কবীর: আমার পিতামহ (দাদা) ছিলেন একজন শিক্ষক। ছাত্ররা দাদাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং এসে ছবি তুলে নিয়ে যেতেন। তা দেখেই আমার শিক্ষক হওয়ার আগ্রহ জাগে।  

বাংলানিউজ: পড়াশোনায় কিভাবে এগিয়ে গেলেন?

শাহনাজ কবীর: আমার মা’র কম বয়সে বিয়ে হয়। পড়াশোনা করতে পারেননি তিনি। আমি যখন পড়তে বসতাম, তখন মা পাশে এসে দেখতেন। আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন। আমি বুঝতে পারি মায়ের আশা পূরণ করতে হবে। আর বাবারও ইচ্ছে ছিলো আমি যেনো পড়াশোনা করে অনেক বড় মানুষ হই।  

বাংলানিউজ: শিক্ষকতা পেশায় কিভাবে এলেন?

শাহনাজ কবীর: আমার প্রবল ইচ্ছে ছিলো শিক্ষক হবো। আর তাই ওইভাবে পড়াশোনা শেষ করে প্রস্তুতি নিলাম। শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় পাস করে ১৯৯৭ সালে ঐতিহ্যবাহী নোয়াখালী জিলা স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে আমার শিক্ষকতা জীবনের শুরু।  

বাংলানিউজ: শরীরে ক্যান্সার কিভাবে জানলেন?

শাহনাজ কবীর: পিঠে হঠাৎ প্রচণ্ড ব্যথা। চেয়ারে বসতে পারি না। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে এ অবস্থা। পরে ঢাকায় গিয়ে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করালে চিকিৎসকরা ক্যান্সার হওয়ার কথা জানান। পরে ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নেই। বোনম্যারো ট্রান্সফার করে চিকিৎসা নিয়ে এখন আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছি।  

বাংলানিউজ: এখন কাজে-কর্মে কোনো সমস্যা হয়?

শাহনাজ কবীর: না, আগের মতোই সব কাজকর্ম করতে পারি।  

বাংলানিউজ: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে কিছু বলুন?

শাহনাজ কবীর: আমার কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের বেশি করে পড়তে হবে, জানতে হবে। তাহলেই তারা ভালো ফলাফল করবে। তারা মেধাবী হয়ে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করবে। আর শিক্ষকদের উদ্দেশে বলতে চাই আমিও তাদের মতো একজন শিক্ষক। সততা ও কর্তব্যপরায়ণের মাধ্যমে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে গেলে আপনারাও আমার মতো দেশসেরা ‘প্রধান শিক্ষক’ হতে পারবেন।
 
বাংলানিউজ: আপা, আপনাকে ধন্যবাদ।
 
শাহনাজ কবীর: আপনাকেও ধন্যবাদ।

২০ জুলাই তিনি পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবের মক্কায় যাচ্ছেন। এর জন্য কিশোরগঞ্জবাসীসহ দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।  
 
এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়এক নজরে শাহনাজ কবীর
মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দেশের সেরা ‘প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত হয়েছেন কিশোরগঞ্জ শহরের এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীর।  

‘জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ ২০১৯’ উপলক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাকে দেশের সেরা ‘প্রধান শিক্ষক’ নির্বাচিত করে।

এর আগে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০১৯ এ শাহনাজ কবীর প্রথমে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা পর্যায়ে ও পরে কিশোরগঞ্জ জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ অঞ্চলের সেরা প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে তিনি জাতীয় পর্যায়ের বাছাইয়ে নাম লেখান।

আগামী ২৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে দেশসেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান-‘প্রধান শিক্ষক’ হিসেবে এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহনাজ কবীরকে পুরস্কৃত করা হবে।

১৯৭০ সালের ১৮ মার্চ হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার কুমড়ি-দুর্গাপুর গ্রামে শাহনাজ কবীর জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুক্তিযোদ্ধা শামছুল কবীর ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মাতা সুফিয়া কবীর গৃহিণী।  

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত। স্বামী ড. রফিকুল ইসলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জননী।

দারুণ মেধাবী শাহনাজ কবীর মুন্সিগঞ্জ এভি জেএম সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে প্রথম বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন। কিশোরগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে ১৯৯০ সালে বিএ এবং আনন্দমোহন সরকারি কলেজ থেকে ১৯৯২ সালে এমএ পাস করেন তিনি। এরপর ১৯৯৩-৯৪ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (মহিলা) ময়মনসিংহ থেকে বিএড প্রশিক্ষণে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। ১৯৯৪-৯৫ শিক্ষাবর্ষে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ময়মনসিংহ থেকে এমএড প্রশিক্ষণেও প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।

১৯৯৭ সালে ঐতিহ্যবাহী নোয়াখালী জিলা স্কুলে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শাহনাজ কবীরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের শুরু হয়। এরপর তিনি ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা (ইংরেজি) পদে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৩ সালের পিএসসি (বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন) এর মাধ্যমে সরাসরি সহকারী প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন শাহনাজ কবীর।  

২০০৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ২০০৬ সালের ৬ মার্চ তিনি কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহ্যবাহী এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে ২০১০ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হন। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১২ ও ২০১৩ সালে টানা দু’বার এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফলে এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। এরপর ২০১৫ সাল থেকে শতভাগ পাস ও সর্বাধিক জিপিএ-৫ পেয়ে কিশোরগঞ্জ জেলায় ধারাবাহিকভাবে প্রথমস্থান দখল করে আছে এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলেও এসভি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের মোট ২৩৯ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১৩৬ জন জিপিএ-৫ পেয়ে শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করে জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে।

২০১৫ ও ২০১৬ সালে সমকাল-বিজ্ঞান বির্তক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ও দুদক বির্তকে রানার্সআপসহ বিভিন্ন সময় আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ এবং গার্লস গাইড, গার্লস গাইড দল, শিক্ষক, শিক্ষার্থীও শ্রেষ্ঠ হয়েছে। পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও সরব অংশগ্রহণ রয়েছে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীদের।

তার সুযোগ্য নেতৃত্বে এসভি সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় জেলার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, জুন ২৬, ২০১৯ 
আরএ/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।