ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্মনিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩০ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৯
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্মনিয়ন্ত্রণই বড় চ্যালেঞ্জ রোহিঙ্গা ক্যাম্প

কক্সবাজার: কুসংস্কার, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস এবং পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহের কারণেই রোহিঙ্গাদের সন্তান জন্মদানের হার বেশি। এছাড়াও অধিক জনসংখ্যা বেশি ত্রাণ পেতে সহায়ক এবং সামাজিক শক্তি বলে মনে করেন রোহিঙ্গারা। যে কারণে ক্যাম্পগুলোতে দ্রুত বাড়ছে জনসংখ্যা।

তবে এভাবে চলতে থাকলে রোহিঙ্গা শিবিরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই দিনদিন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে মানবিক সংকট প্রকট হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

তবে কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে বলেন, ‘দেড় বছরের মাথায় এসে সেই অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। শুরুর দিকে কিছুটা অনাগ্রহ থাকলেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের কাউন্সেলিংয়ের কারণে রোহিঙ্গারা এখন পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন। এমনকি আইসিসিডিআরবি’র একটি সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে শতকরা ৩৪.৭ ভাগ নারী-পুরুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন’।  

তিনি আরো বলেন বলেন, রাখাইনে থাকতে রোহিঙ্গারা পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে কোনো ধারনা পায়নি, পাশাপাশি  পরিবার পরিকল্পনা সর্ম্পকে তাদের অনাগ্রহ, কুসংস্কার, ধমীর্য় অন্ধবিশ্বাসের কারণে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি মানছেন না। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দ্রুতগতিতে জনসংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার গর্ভবতী নারী রয়েছেন বলে জানান তিনি।

‘বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য, চিকিৎসাসহ  মানবিক সহযোগিতার পাশাপাশি প্রায় ২০টি দেশি-বিদেশি সংস্থা জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা দিচ্ছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা এ বিষয়ে মোটেও আগ্রহী নন। এমনকি সেবা দিতে গিয়ে রোহিঙ্গাদের হাতে নাজেহালও হতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের, যোগ করেন পিন্টু।  

উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত একটি বেসরকারি সংস্থার এক কর্মী নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, কাউন্সেলিংয়ের কারণে রোহিঙ্গাদের আচরণ কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে ঠিক, কিন্তু তা মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়। কারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে কুসংস্কারের মাত্রা এতটাই প্রকট যে তারা সন্তান জন্মদানকে ইতিবাচকভাবে দেখেন। এছাড়াও তাদের মধ্যে ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসও বেশি।
 
রোহিঙ্গারা যা বলেন
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নুর উদ্দিন (৩২) বলেন, ‘আমি দুই বছর আগে বিয়ে করেছি। জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকে আমাদের ওষুধপত্র দিতে আসে, কিন্তু আমরা এসব নেই না। নিলেও ব্যবহার করি না। কারণ এসব গুনাহ’।

একই এলাকার ফরিদ উদ্দিন বলেন, ‘এসব ওষুধ আমরা নিজেও খাইনা, স্ত্রীকেও খেতে দিই না’।  

২০ মাসে ৪০ হাজার নতুন শিশু
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ’র বরাত দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গতবছর এক লাখ নতুন শিশুর জন্মের খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও, এ বছর সেরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

তবে কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য বাংলানিউজকে বলেন, ‘পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরসহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত প্রায় ২০টি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত প্রায় ২০ মাসে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার।

তবে অপ্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারির তথ্য আমাদের কাছে না থাকলেও ইউএনএফপিএসহ বিভিন্ন সংস্থার হিসাব মতে, এ সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। বিভিন্ন তথ্য মতে প্রতিদিন প্রায় ৬০টি শিশু রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এক্সপাউরুল-এর প্রধান নির্বাহী ইঞ্জিনিয়ার কানন পাল বাংলানিউজকে বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। ক্যাম্পে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, প্রত্যাবাসন যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে আমাদের দেশে আমরাই সংখ্যালঘু হয়ে যাবো।  

কক্সবাজার সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, রাখাইন রাজ্যে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে কোনো কর্মসূচি ছিল না। এছাড়াও তাদের মধ্যে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, ধর্মীয় গোঁড়ামিও প্রকট। অনেকে অধিক ত্রাণের আশায়ও সন্তান জন্ম দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।  

নাম প্রকাশ না শর্তে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার চাপে বহুমাত্রিক দুর্ভোগে পড়েছে বাংলাদেশে। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে নতুন সংকটে পড়বে কক্সবাজারবাসী।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের পুরনো দুটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে সচেতনতামূলক জোরদার কর্মসূচি আছে। নতুন ক্যাম্পগুলোতেও একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের সচেতন করার পাশাপাশি ইউএনএফপিএ, ইউনিসেফ এবং সরকারের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরসহ বেশ কিছু সংস্থা এখন ক্যাম্পে কাজ করছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। নতুন পুরনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে এখন বসবাস করছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা।  

বাংলাদেশ সময়: ০৫২৮ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৯
এসবি/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।