ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ঘুরে আসুন নেত্রকোণার সোমেশ্বরী আর চীনামাটির পাহাড়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৩ ঘণ্টা, জুন ৮, ২০১৯
ঘুরে আসুন নেত্রকোণার সোমেশ্বরী আর চীনামাটির পাহাড় দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদী ও চীনামাটির পাহাড়। ছবি: বাংলানিউজ

দুর্গাপুর (নেত্রকোণা) থেকে ফিরে: ভ্রমণ পিপাসু বা পর্যটক এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যিনি নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলা সম্পর্কে অবগত নন। প্রাকৃতিক রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর এই উপজেলার প্রধান আকর্ষণ বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড় ও রঙিন পানির কূপ।

হাজারো পরিবারের জীবিকার উৎস স্বচ্ছ জলের দৃষ্টিনন্দন সোমেশ্বরী নদী পাড়ি দিলেই আপনার দর্শনের অপেক্ষায় থাকা প্রাকৃতিক সম্পদ চীনামাটির বিশাল পাহাড় চোখে পড়বে।

এছাড়াও দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, টংক ও কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ নেত্রী হাজংমাতা শহীদ রাশিমণি স্মৃতিসৌধ, কমলা রাণীর দিঘী, মানব কল্যাণকামী অনাথালয়।

উপজেলাটিতে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের যাতায়াত দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে ৩১৬ কোটি টাকায় শ্যামগঞ্জ-দুর্গাপুর সড়কটি তৈরি করেছে সরকার।

নতুন এ সড়কটি চালু হওয়ার পর থেকে চাঙ্গা হয়েছে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য আর বেড়েছে পর্যটক সমাগম।  

চীনামাটির পাহাড়।  ছবি: বাংলানিউজচীনামাটির পাহাড় : 

নৌকায় চড়ে সোমেশ্বরী নদী পাড়ি দিলেই ভারত সীমান্ত ঘেঁষা দুর্গাপুরের কুল্লাগড়া ইউনিয়ন। সেখানে আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের চীনামাটির পাহাড়।  

এই পাহাড়ের বুকে জেগে উঠেছে বাহারি পানির লেক। মাটি উত্তোলনের ফলেই মূলত রঙিন পানির এসব কূপ তৈরি হয় যা দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয় নিমিষে।

সাদা, কালো, লাল, হলুদ ও গোলাপিসহ চীনামাটিরও আছে হরেক রঙ। একসময় এই চীনামাটি উত্তোলন করে চলতো হাজারো পরিবার। আর চিনামাটি চলে যেত দেশের বড়বড় সিরামিক শিল্প কারখানায়।  

দেশের বৃহৎখনিজ অঞ্চল হিসেবেও পরিচিত বিজয়পুর চীনামাটির এই পাহাড়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাহাড়গুলো আগামী তিনশো বছর পর্যন্ত দেশের সিরামিক শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।

সোমেশ্বরী নদী।  ছবি: বাংলানিউজসোমেশ্বরী নদী:

দুর্গাপুরকে আগলে রেখেছে বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্ত নদী সোমেশ্বরী। এই নদীটিকে ঘিরে নির্ভর করে স্থানীয় আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজার হাজার পরিবারের জীবন জীবিকা।

নদী থেকে প্রতিদিন উত্তোলন হয় মাছ আর অজস্র পরিমাণ বালু, পাথর ও কয়লা। শ্রমিকরা দিনভর নদী থেকে প্রাকৃতিক এসব সম্পদ তুলে বিক্রি করে সংসার চালান। আর প্রতিবছর এ থেকে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব আয় করে সরকার।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি।  ছবি: বাংলানিউজক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি: 

দুর্গাপুর বাসস্ট্যান্ডের একদম অভিমুখে উৎরাইল বাজার এলাকায় রয়েছে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি। এখানে প্রতিদিনই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর লোকজন তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চা চালিয়ে যান।  

প্রতিবছর জমকালো পরিবেশে আদিবাসীরা নিজেদের জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো পালন করে আর এতে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর পরিমাণ জনসমাগম হয়। একাডেমিতে রয়েছে নিজস্ব রেস্ট হাউজ নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে অতিথিরা এখানে রাত্রিযাপন করতে পারেন।

সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী বা রাণীখং মিশন।  ছবি: বাংলানিউজসাধু যোসেফের ধর্মপল্লী বা রাণীখং মিশন: 

সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী বা রাণীখং মিশন উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম আরেক আকর্ষণ। সোমেশ্বরী নদী আর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কূল ঘেঁষা পাহাড়ি টিলায় শতবছরের পুরাতন এ মিশন। প্রতিদিন দর্শনার্থীরা মিশনটির সৌন্দর্য উপভোগ আর ইতিহাস জানতে ছুটে আসেন।

রাণীখং নামে পাহাড়ি এই টিলা নিয়ে জনশ্রুতি রয়েছে সেখানে একসময় খংরাণী নামে এক রাক্ষুসি বসবাস করতো। আদিবাসীরা ওই রাক্ষুসিকে বধ করে সেখানে জনবসতি গড়ে তোলেন।  

পরে সুসং রাজ্যের রাজার কাছ থেকে জমিটি বন্দোবস্ত নিয়ে স্থায়ী বা প্রতিষ্ঠা করা হয় মিশন ও ক্যাথলিক গীর্জা যা সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি টিলায় অসম্ভব সুন্দর এ স্থাপনা।

এখানে রয়েছে ধর্মপাল বিশপ হার্থসহ পাঁচ গারো হাজং আদিবাসীর মূর্তিসংবলিত নান্দনিক ভাস্কর্য। ঠিক এর পাশেই খ্রিস্ট আর তার কিছু দূরে সাধু যোসেফের মূর্তি এবং ক্যাথলিক গীর্জা।  

ছিমছাম পরিবেশে গড়ে তোলা ধর্মপল্লীটিতে রয়েছে ফুলফলসহ নানারকম ঔষধি গাছের সমারোহ। বিশ্রামাগারের পাশে এখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় মেঘবৃষ্টির লুকোচুরি খেলা। চিকচিক করে উঠা সোমেশ্বরীর সিলিকা বালি দৃষ্টি কেড়ে নেয় দর্শনার্থীর।

টংক ও কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ নেত্রী হাজংমাতা শহীদ রাশিমণি স্মৃতিসৌধ।  ছবি: বাংলানিউজএদিকে বিজয়পুর চিনামাটি যাওয়ার পথে বহেড়াতলি এলাকার চৌরাস্তায় রয়েছে টংক ও কৃষক আন্দোলনের পথিকৃৎ নেত্রী হাজংমাতা শহীদ রাশিমণি স্মৃতিসৌধ।

রাশিমণি ছিলেন কৃষক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় সংগ্রামে অগ্রপথিক। তিনি জমিদার ও ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের সময় কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে গিয়ে ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি, শত্রুপক্ষের গুলিতে শহীদ হন। এসময় শহীদ হন রাশিমণির সহযোদ্ধা সুরেন্দ্র হাজং। তারাই ছিলেন টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ।

বীর শহীদ ও তাদের অবদান স্মরণীয় করে রাখার জন্য বহেড়াতলি চৌরাস্তায় স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়। এরপর থেকেই প্রতিবছর সংশ্লিষ্ট কমিটি রাশিমণি দিবস ও টংক শহীদ দিবস পালনের পাশাপাশি রাশিমণি মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। মেলায় দূর-দূরান্তের মানুষের সমাগম হয় প্রতিবছরই।

কমলা রাণীর দিঘীকমলা রাণীর দিঘী: 
জনশ্রুতি রয়েছে কমলা রাণীর দিঘী নামটির পেছনে রয়েছে করুণ এক ইতিহাস। যা শুনলে যে কারো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে পানি। উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের পাশেই কমলা রাণীর দিঘীর অবস্থান।

জনশ্রুতি এই রয়েছে- অপূর্ব সুন্দরী নারী কমলাকে বিয়ে করেছিলেন সুসং রাজ্যের রাজা জানকী নাথ। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই ছিলেন পরম ধার্মিক। রাজ্যের প্রজাদের জন্য সর্বচ্চো ত্যাগটুকু করতে পিছপা হতেন না তারা। রঘু নাথ নামে তাদের এক সন্তান ছিলো।

একবার রাজ্যের প্রজাদের পানির অভাব দূর করতে পুকুর খনন করেন রাজা জানকী। কিন্তু পুকুরে পানি উঠে না কিছুতেই। পরবর্তীতে স্বপ্নে রাজা জানতে পারেন রাণী কমলা পুকুরের মাঝখানে বসে পূজা দিলেই পানিতে ভরে যাবে পুকুর।

 ছবি: বাংলানিউজস্বপ্নের সূত্র ধরে রাজার নির্দেশে পূজায় বসেন রাণী আর পানি উঠে তলিয়ে যায়। দুগ্ধজাত সন্তানকে নিয়ে বিপাকে পড়েন রাজা। তিনি ফের স্বপ্ন দেখেন রাজা প্রতি রাতে ছেলেকে পুকুর পাড়ে রেখে আসলে রাণী সন্তানকে দুধ পান করিয়ে যাবেন কিন্তু শর্ত রাজা কখনোই রাণীকে স্পর্শ করতে পারবেন না। একদিন রাজা শর্ত ভঙ্গ করে রাণীকে ছুঁয়ে দিলেন তারপর সেই যে গেলো রাণী আরো এলো না দুগ্ধজাত সন্তানের জন্য।

মানবসেবায় ব্রত উপজেলার চন্ডিগড় ইউনিয়নের নাথপাড়া গ্রামের সাধুপুরুষ নিত্যানন্দ গোস্বামী নয়ন। অনাথদের জন্য সবকিছু দান করে দিয়েছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন মানব কল্যাণকামী অনাথালয়।
অনাথালয়টিতে শতাধিক ছেলেমেয়ের বসবাস। পড়ালেখা থেকে শুরু করে থাকা-খাওয়া সব কিছু বহন করেন সাধুপুরুষ নয়ন। বিশাল এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা অনাথালয়ে গোলাপসহ দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন ফুলের বাগান, রয়েছে মাছে ভরা পুকুর।

পাশাপাশি অনাথালয়েই রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমসহ স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা গরীব অসহায় নারীদের আশ্রয়স্থল। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় প্রতিদিন দর্শনার্থীরা অনাথালয়টি পরিদর্শন করে যান। ধর্ম নিয়ে কোনো বিধি নিষেধ নেই এখানে সব ধর্মের মানুষই চাইলে এখানে আশ্রয় পান।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, জুন ০৮, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।