হাওর এলাকার অন্যতম সেরা আকর্ষণ এই আখড়া। নদীর তীরে হিজল গাছের সারি, প্রাচীন দেয়াল ও অট্টালিকা, ভেতরে অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে যেকোনো আগন্তুককে কাছে টানবে।
আরও রয়েছে- ধর্মশালা, নাটমন্দির, অতিথিশালা, পাকশালা ও বৈষ্ণবদেব থাকার ঘর। আখড়ার দুদিকে রয়েছে দুটি পুকুর। আর আখড়ার চারপাশে বিশাল এলাকাজুড়ে মৃত্তিকা বিদীর্ণ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আখড়ার সময়কালের তিন হাজার হিজল গাছ। প্রাচীন এই আখড়ার আর হিজল গাছগুলো হাওরের এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি যা সবাইকেই হাতছানি দিয়ে ডাকে।
দিল্লির আখড়ার ইতিহাস: দিল্লির আখড়া ও হিজল গাছগুলোকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে প্রচলিত আছে গা ছমছম করা কাহিনী। প্রায় ৪০০ বছর আগের কথা, দিল্লির আখড়া প্রতিষ্ঠাতা আধ্যাত্মিক সাধু নারায়ণ গোস্বামী ছিলেন পার্শ্ববর্তী বিতলঙ্গের আখড়ার আধ্যাত্মিক সাধক রামকৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্য। সে সময় এলাকাটি ঝোপ জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল, কোনো হিজল গাছ ছিলো না। এলাকাটির চারদিকে ছিল নদী বেষ্টিত। ফলে আখড়া এলাকটিকে মনে হতো দ্বীপের মতো। এ নদীপথে কোনো নৌ চলাচল করতে পারতো না। রহস্যজনক কারণে এ নদীপথে চলাচলকারী নৌকা ডুবে যেতো বা অন্যকোনো দুর্ঘটনায় পতিত হতো, একদিন এ নদীপথে দিল্লির সম্রাট প্রেরিত একটি কোষা নৌকা মালামালসহ ডুবে যায়। আরোহীরা অনেক চেষ্টার পরও কোষাটি উঠাতে গিয়ে ব্যর্থ হন এবং তাদের একজন সর্পদংশনে মারা যান।
বিতলঙ্গের সাধক রামকৃষ্ণ এ খবর পেয়ে শিষ্য নারায়ণ গোস্বামীকে এখানে আসার নির্দেশ দেন। গুরুদেবের নির্দেশ মোতাবেক সাধক নারায়ণ গোস্বামী এখানে এসে নদীর তীরে বসে তপস্যায়রত হলেন। হঠাৎ অলৌকিক ক্ষমতা বলে কে যেন তাকে হাত পা-বেঁধে নদীতে ফেলে দেয়।
ঐশী ক্ষমতাবলে তিনি তীরে উঠে আসেন। এভাবে প্রায় সাতদিন একই ঘটনা ঘটান। একদিন দৈব বাণীর মতো কে যেন বলল, আপনি এখানে থাকতে পারবেন না, এখান থেকে চলে যান। উত্তরে সাধক বললেন, তোমরা কারা? উত্তর আসলো আমরা এখানকার বাসিন্দা। পূর্ব পুরুষ ধরে এখানে আছি। আপনার কারণে আমাদের সমস্যা হচ্ছে। সাধক বললেন, তোমরা স্পষ্ট হও, অর্থাৎ রূপ ধারণ করো। সঙ্গে সঙ্গে তারা বিকট দানব মূর্তি ধারণ করলো।
নারায়ণ গোস্বামী দেখলেন তার চারপাশে হাজার হাজার বিশালাকার দানব মূর্তি। যা দেখলে সাধারণত গা শিউরে উঠবে। এখন তাদের সঙ্গে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর অনেক কথাবার্তা হয়। সিদ্ধান্ত হয় তিনিও থাকবেন, তারাও থাকবে। তবে তারা কারো কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা এবং নারায়ণ গোস্বামীর নির্দেশ পালন করবেন।
সাধক নারায়ণ গোস্বামী তাদের আদেশ করলেন, তোমরা আমার চারপাশে সবাই হিজল গাছের রূপ ধারণ কর। তখন দানবদের প্রধান সাধুকে অনুরোধ জানিয়ে বললো, সে যে হিজল গাছের মূর্তি ধারণ করবে, সেই গাছের নিচে বসে তপস্যা করতে। সাধু সে অনুরোধ মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটি দানব একেকটি হিজল গাছের মূর্তি ধারণ করলো।
সেই থেকে নারায়ণ গোস্বামী প্রধান দানবের হিজলরূপী বৃক্ষের নিচে বসে সাধন ভজন করতেন। ফলে এর নাম দেওয়া হয় ‘সাধনবৃক্ষ’ আখড়ার অদূরে এখনো রয়েছে সেই বৃক্ষটি। এর চারপাশে বর্তমানে পাকা বেষ্টনী করে রাখা হয়েছে। প্রতি অমাবশ্যা-পূর্ণিমার রাতে এখানে ভোগ দেওয়া হয়।
আখড়ার ৩৭২ একর জমিতে এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অদ্ভুত আকৃতির কয়েক হাজার হিজল গাছ। যা দূর দূরান্তের আগন্তুককে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে। এদিকে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর ঐশী মতা বলে সেই ডুবে যাওয়া কোষাটি মালামালসহ উঠিয়ে দেয় এবং সর্প দংশনে মৃত ব্যক্তিটিকেও বাঁচিয়ে তুলেন।
পরে দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে এ খবর পৌঁছানোর পর তিনি এখানে এসে সাধক নারায়ণ গোস্বামীর নামে বিশাল এলাকা লাখেরাজ দিয়ে একটি আখড়া প্রতিষ্ঠা করে দেন। সেই থেকে আখড়াটি ‘দিল্লির আখড়া’ নামে পরিচিতি হয়ে আসছে।
যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জে বেশ কয়েকটি রুটে হাওরে যাওয়া যায়। তবে সহজ হলো সায়েদাবাদ বা গোলাপবাগ থেকে বাসে অথবা কমলাপুর থেকে ট্রেনে সরাসরি কিশোরগঞ্জ শহরে। কিশোরগঞ্জ শহরে আসার পর একরামপুর এলাকায় গিয়ে অটোরিকশা করে চামড়া নৌ-বন্দর অথবা মরিচখালি বাজারে যেতে হবে। চামড়া নৌ-বন্দরে ইঞ্জিনের নৌকা ও ট্রলার ছাড়াও
স্পিডবোট রয়েছে। আর মরিচখালি বাজার থেকে ইঞ্জিনের নৌকা ও ট্রলার করে বিস্তীর্ণ হাওর পাড়ি দিয়ে কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন দিল্লির আখড়ায়। দিল্লির আখড়া পরিদর্শন শেষে পরের সময়টা কাটাতে পারেন একেবারেই পরিকল্পনা ছাড়া। সব কিছুই নির্ভর করবে পরিস্থিতি ও আবহাওয়ার ওপর। তবে সময়গুলো কাটবে হাওরের ভাসা পানিতেই। বৃষ্টি না হলে ট্রলারের ছাদেই রাত কাটিয়ে দিতে পারেন। তাছাড়া ট্রলারের ভেতরে ঘুমানোর ব্যবস্থা তো আছেই।
ইচ্ছে করলে উপজেলা সদরের ডাকবাংলোতেও রাত কাটানো যায়। এরপর ভাসমান তাবু নিয়ে নৌকা অথবা ট্রলার ঘুরিয়ে দিতে পারেন হাওর উপজেলা ইটনা, কিংবা অষ্টগ্রামের দিকে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৫ ঘণ্টা, জুন ০৭, ২০১৯
এনটি