ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বর্ষার জ্বালানিবন্ধু ‘গইট্টা’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৫ ঘণ্টা, জুন ৬, ২০১৯
বর্ষার জ্বালানিবন্ধু ‘গইট্টা’ রোদে দেওয়া গইট্টা। ছবি: বাংলানিউজ

নেত্রকোণা: ‘গইট্টা', নেত্রকোণা জেলার একটি আঞ্চলিক শব্দ। গরুর গোবর থেকে গ্রামের নারীদের হাতে তৈরি লাকড়ির বিকল্প এক প্রকার জ্বালানির নাম ‘গইট্টা'। কোনো কোনো জেলায় একে মশালও বলে।

বর্ষা মৌসুমে নেত্রকোণার প্রায় প্রতিটি গ্রামে দরিদ্র অসহায় খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সংসারে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ‘গইট্টা’ একমাত্র সম্বল হয়।

বর্ষাকালের কথা মাথায় রেখে গ্রামের সব নারী ফসলের মাঠ থেকে শুরু করে আনাচে-কানাচে পড়ে থাকা গরুর গোবর কুড়িয়ে গইট্টা তৈরি করেন।

আকার-আকৃতি ভেদে এই গইট্টারও আছে ভিন্ন নাম। গইট্টা মূলত দু'টি আকৃতিতে তৈরি হয়। একটি লম্বা লাঠি আকৃতি এবং অপরটি, গোলাকার রুটির মতো। প্রথমটির নাম- মুইট্টা হলেও দ্বিতীয়টি- চডা নামেই বেশ পরিচিত।

নেত্রকোণার খালিয়াজুরী উপজেলার বাসিন্দা গইট্টা ব্যবহারকারী হোসনে বেগম বাংলানিউজকে বলেন, মুইট্টা বানাইতে পাটখড়ি কিনতে হয়। প্রতি মোডা পাটখড়ি আমরা ৩৫/৪০ টাকা কইরা কিনি। মোডায় ৭০-৭৫টা পাটখড়ি থাহে। একেকটা পাটখড়ি আধা হাত কইরা ভাইঙ্গা তার মধ্যে গোবর মিশাইয়া মুইট্টা বানাই।

গোবরের দুর্গন্ধ ও মুইট্টা ব্যবহারে লাভ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে হোসনে বলেন, আমরার কাছে গোবর দুর্গন্ধ মনে হয় না। আর লাভতো আচেই, এই ধরেন বাজারে লাকড়ি হাজার টেহা পর্যন্ত মণ! একজনের আয়ের উপর পাঁচটা মানুষের সংসার। খাওন খরচতো আছেই তাছাড়া তিনটা পোলাপানের পড়াশোনার খরচ।  

‘একটা সংসারে কি পরিমান টেহার প্রয়োজনতো বুজেনই। এখন আমি যদি আমার স্বামীরে হেই লাকড়ির খরচ তিন সাড়ে তিন হাজার টেহার বুঝা থ্যাইকা মুক্তি দিতে পারি হেইডাই মনে করেন লাভ। 'রোদে দেওয়া গইট্টা।  ছবি: বাংলানিউজআর্থিক লাভ ছাড়া মুইট্টা ব্যবহারে অন্যান্য সুবিধা নিয়ে হোসনে আরো জানান, এ্যাতো টেহা দিয়া বাজারের লাকড়ি কিনার পরেও শান্তি নাই রে ভাই। লাকড়ি ভিজা থাহে আগুন জ্বলে না, খালি ধুয়া হয়। চুলায় ফু দিতে দিতেই জীবন শেষ। আর গইট্টার আগুন ফরপরাইয়া জ্বলে, কোনোরকম ধুয়াও নাই। অনেক শান্তির রানদা হয় গইট্টা দিয়া।

হোসনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ অন্য এক নারীর কণ্ঠ কানে ভেসে এলো- ‘হোসনে ওই হোসনে ল হাওরে যাই গোবর লইয়া আইগা'। কথাগুলো বলে বাসার ভিতরে চলে এলেন নারী। তিনি হোসনের প্রতিবেশী কৃষক ইউনুছ মিয়ার স্ত্রী আম্বিয়া আক্তার। কথা হলো এবার তার সঙ্গে।  

গোবর দিয়ে কি করবেন প্রশ্নের উত্তরে আম্বিয়া বলে- ‘চডা দিয়াম। ' চডা কীভাবে তৈরি করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, একমুঠ গোবর হাতে লইয়া রুডির মতো গোল কইরা মাইনসের বা সরকারি ওয়ালে (দেয়ালে) রইদে দিয়া রাহি। গোবর হুকাইলে চডা তৈরি হয়।  

গ্রামে কতজন নারী গইট্টা তৈরি এবং জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে জানতে চাইলে আম্বিয়া জানান, গ্রামের হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া প্রত্যেকেই গোবর টুকাইয়া চডা, মুইট্টা নানান রকম গইট্টা বানায়।

একটি চডা বা মুইট্টা ভালো করে রোদে শুকাতে অন্তত সপ্তাহখানেক সময় লাগে। তারপর সেগুলো জ্বালানির কাজে ব্যবহার উপযোগী হয়। রোদে এসব গইট্টা ভালোভাবে না শুকালে রান্নার সময় দুর্গন্ধ এবং ধোঁয়া হয় বলেও জানান হোসনে ও আম্বিয়া।

বাজারে লাকড়ি থাকতে এতো কষ্ট করে নোংরা পরিবেশে থেকে জ্বালানির জন্য এ ব্যবস্থা কেন জানতে চাইলে আম্বিয়া বলেন, লাকড়ি কিনে রানদন আমরার সাধ্যের বাইরে। একটা বেডার (পুরুষ) উপরে সংসার। সন্তান নিয়া আমার পরিবারের সদস্য আটজন, তাও সবগুলো সন্তানই চেরি (মেয়ে)। লাকড়ি কিনতে না পাড়লে কি হইবো রানদন খাওনতো লাগবো, আপনে কি কইন (বলেন) মিয়া ভাই?

বর্ষা মৌসুমে গইট্টা গ্রামের এসব নারীদের রান্নার কষ্টের হাত থেকে বাঁচায়। তারা বর্ষা শুরুর আগ থেকেই রান্নার কাজে জ্বালানির জন্য প্রচুর পরিমাণে গোবর সংগ্রহ করে গইট্টা তৈরি করে শুকিয়ে প্লাস্টিক বস্তায় ভরে রাখে। কেননা বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে কোথাও কোনো গাছের শুকনো ডালপালা এমনকি পাতাও কুড়াতে পারে না তারা। কাজেই বর্ষায় জ্বালানি হিসেবে পরমবন্ধুর কাজ করে গোবরের তৈরি ‘গইট্টা'।

গোবরের তৈরি গইট্টা নিয়ে নেত্রকোণা আধুনিক সদর হাসপাতাল ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. নিলোৎপল তালুকদার বাংলানিউজকে বলেন, গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো তারা জানে না, গোবর থেকে পেটের পীড়াসহ কৃমির সমস্যা হতে পারে। একজন চিকিৎসক হিসেবে স্বাস্থ্য সচেতনতায় আমি মনে করি, অল্প লাভের চিন্তা না করে, রোগ-জীবাণু আছে এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি হতে পারে এসব নোংরা পরিবেশে না যাওয়াই ভালো।

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৬ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৯
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।