ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ঈদের বিনোদনকেন্দ্র প্রাচীন ‘মজলিশ আউলিয়া’ মসজিদ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০২ ঘণ্টা, জুন ৫, ২০১৯
ঈদের বিনোদনকেন্দ্র প্রাচীন ‘মজলিশ আউলিয়া’ মসজিদ রাতের আঁধারে মসজিদটি তৈরি হয়েছে বলে ধারণা স্থানীয়দের। ছবি: বাংলানিউজ

মাদারীপুর: পবিত্র ঈদুল ফিতরকে ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই। শহরবাসীর কাছে ঈদ হলো নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। নানা দর্শনীয় স্থান বা পর্যটনকেন্দ্রে আনন্দময় সময় কাটানো। তবে গ্রামের মানুষদের ঈদের দিনটি একটু ভিন্নভাবে কাটে। সকাল নামাজ শেষ করে প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধবদের বাসায়, পাড়া-প্রতিবেশিদের ঘরে গিয়ে ঈদের মিষ্টিমুখ করার পর্ব এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সকালের পর্ব শেষ হলেই দলে দলে ঘুরতে বের হয় গ্রামের শিশু-কিশোর।

শহরের মতো গ্রামে পিকনিক স্পট বা পার্ক না থাকায় নদীর পাড়, বড় কোনো সেতু, গ্রামের মনোরম কোনো পরিবেশকেই আদর্শ স্থান হিসেবে বেছে নেয় গ্রামের সাধারণ মানুষ। তবে সম্প্রতি একটি প্রাচীন মসজিদকে ঘিরে ঈদ মৌসুমে দেখা যায় দর্শনার্থীদের ঢল।

সকাল থেকে ঈদের ছুটি শেষ হবার আগ পর্যন্ত নানা স্থানের মানুষের পদচারণায় মুখোর থাকে প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত এই প্রাচীণ স্থাপনাকে ঘিরে।

মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার কোল ঘেঁষে ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের পাথরাইল-দিঘিরপাড় গ্রামে অবস্থিত ‘মজলিশ আউলিয়া’ মসজিদটি দেখতে দর্শনার্থীরা ভিড় জমায় ঈদের ছুটির দিনগুলোতে। গ্রামের মানুষের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে এই ‘মজলিশ আউলিয়া’ মসজিদটি।

মসজিদটি ঘিরে এলাকাবাসীর ধারণাটা ভিন্ন রকম। যা বিস্মিত করে দর্শনার্থীদেরও। জনশ্রুতি রয়েছে মসজিদটি ‘গায়েবি মসজিদ’। কোনো এক সময় রাতের আঁধারে মসজিদটি তৈরি হয়েছে বলে ধারণা স্থানীয়দের। মসজিদের সামনেই রয়েছে বিশাল এক দিঘি। এই দিঘিটির পশ্চিম পাড়ের প্রায় দুশ’ গজ সামনেই অবস্থিত মজলিশ আউলিয়া মসজিদ। মসজিদের সামনের বিশাল দিঘিটির কারণে ওই এলাকার নাম পাতরাইল থেকে ক্রমান্বয়ে  দিঘিরপাড়’ পরিণত হয়েছে।

স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করলে তারা বাংলানিউজকে বলেন, মসজিদ ও দিঘি নিয়ে অনেক জনশ্রুতিই প্রচলিত আছে। কিন্তু এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। এলাকার সবাই বিষয়টি শুনে এসেছে। ৮০ বছর বয়স্করাও তাদের পূর্বপুরুষদের কাছে দিঘির অলৌকিক ক্ষমতার কথা শুনে এসেছে, কিন্তু চোখে দেখেনি। ‘গায়েবি মসজিদ’ বিষয়টি এখন আর কেউ মনে করে না।

দশ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির অভ্যন্তরে পূর্বদিক থেকে পাঁচটি দরজার মাধ্যমে প্রবেশ করা যায়। স্বতন্ত্রভাবে দণ্ডায়মান চারটি পাথরের স্তম্ভ গঠিত একটি স্তম্ভসারি মসজিদের ভেতরকে দুইটি ‘আইল’এ বিভক্ত করেছে। উত্তর ও পশ্চিম দেয়ালে দুইটি করে দরজা রয়েছে। মসজিদের দেয়াল প্রায় দুই মিটার পুরু; এবং ভেতরের পরিমাপ (২১.৫৫ মিটার ও ৮.৬০ মিটার)। পূর্ব দেয়ালের পাঁচটি দরজা বরাবর পশ্চিম দেয়াল অভ্যন্তরে পাঁচটি ‘মিহরাব’ রয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের দুই খিলানের মধ্যবর্তী অংশ চৌচালা ভল্ট সদৃশ, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দরজার সংশ্লিষ্ট অংশ দোচালা ভল্ট সদৃশ। মসজিদটির নকশায় পোড়ামাটির অলংকার এবং দেয়ালের গায়ে আঙ্গুর লতার মতো নকশা অংকিত।

বাংলাপিডিয়া’র তথ্য অনুযায়ী মসজিদটির সঙ্গে ‘লখনৌতির ছোট সোনা মসজিদ’ ও রাজশাহীর ‘বাঘা মসজিদ’ এর যথেষ্ট মিল রয়েছে। এই শৈলীগত সাদৃশ্যতার জন্য মসজিদটিকে ‘হোসেন শাহী ইমারত’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ; এবং ধারণা করা হয় এটি ষোড়শ শতাব্দীর প্রারম্ভে খুব সম্ভবত নাসিরউদ্দিন নসরত শাহের আমলে তৈরি।

অন্যদিকে, উইকিপিডিয়া ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, মজলিশ আউলিয়া মসজিদটি ১৩৯৩ থেকে ১৪১০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের দক্ষিণ পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন মজলিশ আউলিয়া খান। যার নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়। মসজিদটির আঙিনায় মস্তান দরবেশ নাজিমউদ্দিন দেওয়ানের মাজার। আওলিয়া খানের মাজাদের দক্ষিণপাশে ফকির ছলিমদ্দিন দেওয়ানের মাজার।

দেয়ালের গায়ে আঙ্গুর লতার মতো নকশা আঁকা।  ছবি: বাংলানিউজ

জানা গেছে, সে সময় বিখ্যাত সুফি সাধক দরবেশ আউলিয়া আব্দুল্লাহ খান মজলিশ তার সাগ্রেদদের নিয়ে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে আসেন। তারই উদ্যোগে ও তত্ত্বাবধানে এ মসজিদ গড়ে তোলা হয়। পরে, তার নামানুসারে মসজিদের নামকরণ করা হয় আউলিয়া মসজিদ। মসজিদের সামনে ৩২.১৫ একর জমির উপর একটি দিঘি খনন করা হয়। সে সময় এলাকায় পানির প্রচণ্ড অভাব ছিল। এ থেকে মানুষের পরিত্রানের জন্য দরবেশ আউলিয়া আব্দুল্লাহ খান এ সুবিশাল দিঘি খনন করান। পরে দিঘির নামের সঙ্গে যুক্ত করে এলাকার নামকরণ করা হয় পাতরাইল দীঘিরপাড়। আউলিয়া আব্দুল্লাহ খান মজলিশ এখানেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।

মজলিশ আউলিয়া মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ আসেন। তবে ঈদ মৌসুমে দর্শনার্থীদের ভিড় বেড়ে যায় কয়েকগুণ। দূর-দূরান্ত থেকে শত শত মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে মসজিদ প্রাঙ্গণ। কেউ বা ‘মানত’ পূরণ করতে আসে। কেউ বা আসে দেখতে। তবে, দর্শনার্থীদের জন্য এখানে তেমন কোনো সুব্যবস্থা নেই।  

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নিয়োজিত মসজিদটির সাবেক কেয়ারটেকার মো. গিয়াসউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, মসজিদটি দেখতে প্রচুর দর্শনার্থী এখানে আসে। মসজিদটির সংস্কারের জন্য বিভিন্ন সময়ে কাজ করা হয়েছে। আগামীতে সীমানা প্রাচীরও করা হবে। সরকার উদ্যোগী হলে এই মসজিদটি ঘিরেই গড়ে উঠতে পারে পর্যটনকেন্দ্র।

যেভাবে আসবেন
রাজধানী ঢাকা থেকে ঢাকা-মাওয়া সড়ক হয়ে শিমুলিয়া ঘাট। পদ্মানদী পাড় হয়ে কাঁঠালবাড়ী ঘাট থেকে ভাঙ্গাগামী কোনো পরিবহনে উঠে পুলিয়া নামক স্থানে নামতে হবে। সেখান থেকে ভ্যান বা অটোরিকশায় করে দিঘিরপাড় মজলিশ আউলিয়া মসজিদে পৌছানো যাবে। পুলিয়া থেকে দূরত্ব ৫/৬ কিলোমিটার।

ইসলাম ও জীবনঘনিষ্ঠ যেকোনো লেখা আপনিও দিতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০২০১ ঘন্টা, জুন ০৫, ২০১৯
এমএমইউ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ