সকাল ১০টা ২২ মিনিটের দিকে স্প্যানটি নিয়ে রওয়ানা হয় তিন হাজার ৬০০ টন ধারণ ক্ষমতার ক্রেন ‘তিয়ান ই’। নদীর স্রোত ঠেলে ক্রেনটি ১৪ ও ১৫ নম্বর পিলারের পাশে পৌঁছায় বেলা ১১টা ১০ মিনিটের দিকে।
পরদিন উত্তাল নদী আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দেখেও একেবারে সকাল থেকে দেশি-বিদেশি প্রকৌশলীরা শুরু করেন স্প্যানটিকে ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে দুই পিলারের বেয়ারিংয়ের ওপর বসানোর কাজ। সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটের দিকে তারা সফল হন। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সফলভাবে বসে পদ্মাসেতুর তৃতীয় মডিউলের দুই নম্বর স্প্যানটি। দৃশ্যমান হয় প্রায় দুই কিলোমিটার বা ১৯৫০ মিটার।
উদ্যোগ নেওয়ার পর অর্থায়নে প্রথমবার ধাক্কা খাওয়া থেকে শুরু করে পদ্মাসেতু নির্মাণে এখন পর্যন্ত যতো বাধা ডিঙাতে হচ্ছে, তার মধ্যে এমন প্রাকৃতিক বা আবহাওয়াজনিত বাধাও অজস্র। এই অজস্র বাধা ডিঙিয়েই বাস্তব হয়ে ধরা দিচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলসহ পুরো দেশবাসীর স্বপ্ন-সেতু।
কেউ কেউ পদ্মাসেতু নির্মাণে কালবিলম্ব নিয়ে দু’চার কথা বললেও সংশ্লিষ্টরা এসব কানে নেন না। তারা মনে করেন, অনেক বড় সাহস করে নিজেদের অর্থে পদ্মাসেতু বানানো হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্পের এ কাজে যেন কোনো খুঁত না থাকে, সেটাই নিশ্চিত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তারা। তাদের ভাষ্যে, এতো বিশাল কর্মযজ্ঞে ভুলের কোনো খেসারত নেই। কারণ, একটি কাজ আরেকটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এক কাজে খুঁত থেকে গেলে তার ছাপ পড়বে অন্য সব কাজে। বিলম্ব নিয়ে অন্যদেশের সেতুগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হলেও এখানকার প্রকৌশলীরা বলছেন, পদ্মাসেতু নির্মাণে এমন কিছু কাজ হচ্ছে যেটা অতীতে কোথাও কখনো হয়নি। পদ্মাসেতুই বিশ্বের প্রথম বড় কোনো সেতু যার ভিত্তি (পাইল) ১২০ ফুট গভীরে প্রোথিত হচ্ছে। এ সেতুতে যে আকারের পাইল ব্যবহার করা হয়েছে তা এখন পর্যন্ত বিশ্বের অন্য কোনো সেতুতেই দেওয়া হয়নি। বিশ্বের অনেক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এই কাজটা পর্যবেক্ষণ করছে।
ক্রেনে করে পিলারের কাছে ত্রয়োদশ স্প্যানটি নিয়ে যাওয়ার সময়ই পদ্মার পাড়ে কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে কথা হচ্ছিলো বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। সেতুর নির্মাণকাজে প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রত্যেকটি কাজ নিখুঁতভাবে করতে আন্তরিক সবাই। কারণ এখানে ভুলের কোনো খেসারত নেই। সেজন্য নদীতে স্রোতপ্রবাহ, ঝড়-বৃষ্টি, সতর্ক সংকেতসহ আবহাওয়াজনিত বিষয়াদি দেখেই কার্যক্রমে হাত দিতে হয়। বাধা এলে সিদ্ধান্ত পেছাতে হয়। কারণ ঝুঁকি নিয়ে এতো বড় প্রকল্পের কাজে কোনো খুঁত রাখার অবকাশ নেই।
নির্মাণযজ্ঞের বিষয়ে তিনি বলেন, পদ্মাসেতু বানানোর কর্মযজ্ঞের জন্য যতখানি এলাকা (৮৪ হেক্টর বা কম-বেশি) দু’পাশে অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাতে অন্তত দু’টি রানওয়ে করা যেতো। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে একটা হ্যামার ব্যবহার হয়েছিল, পদ্মাসেতু নির্মাণে আনা হয়েছে ছয়টা হ্যামার। কাজের দিক থেকে পদ্মাসেতু অনন্য বৈশিষ্ট্যের।
কারিগরি কোনো জটিলতা আর নেই উল্লেখ করে হুমায়ুন কবীর বলেন, সেতু নির্মাণে যতো জটিলতা ছিল সব কেটে গেছে। সব কাজ এখন দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।
নিজেদের অর্থে বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ এ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে। সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। আর নদীশাসনের কাজ করছে চীনেরই আরেক প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হচ্ছে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর কাজ করা হচ্ছে সাতটি মডিউলে ভাগ করে। সপ্তম মডিউলে পাঁচটি স্প্যান, বাকি ছয়টি মডিউলে ছয়টি করে স্প্যান। মূলসেতুতে ২৬২টি পাইলের ওপর বসবে ৪২টি পিলার, তার ওপর বসবে ৪১টি স্প্যান। পানির মধ্যে আছে ৪০টি পিলার। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে যে ১৩টি বসেছে, এর মধ্যে জাজিরা অংশে ৯টি, বাকি ৪টি মাওয়া অংশে। জাজিরা অংশে জাজিরা প্রান্তের স্প্যানগুলোতে রেলওয়ে স্ল্যাব ও রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। এর মধ্যে ২৪ মে পর্যন্ত সড়কের অংশে ২৫টি স্ল্যাব এবং রেললাইনে ৩০০ স্ল্যাব বসেছে।
পুরো প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, নদীশাসন কাজের অগ্রগতি ৫৫ শতাংশের বেশি। সেতুর ২৬২টি পাইলের মধ্যে ২৩৬টির ড্রাইভিং সম্পন্ন। বাকি ২৬টি পাইলের কাজ চলছে। ৪২টি পিলারের মধ্যে ২৫টি পিলারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি ১১টি পিলারের কাজ চলমান। আগামী জুনের মধ্যে আরও ছয়টি পিলারের কাজ সম্পন্ন হবে। জাজিরা প্রান্তে নদীশাসনের কাজ এগিয়ে চলেছে। জাজিরা প্রান্তে টোলপ্লাজা, ওজন সেতুও প্রায় প্রস্তুত, কাজ শেষ অ্যাপ্রোচ রোডের।
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১৯
এইচএ/