ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

সব সরকারের আমলেই দাপট দেখাতেন ইয়াবা গডফাদার সাইফুল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৩ ঘণ্টা, জুন ১, ২০১৯
সব সরকারের আমলেই দাপট দেখাতেন ইয়াবা গডফাদার সাইফুল ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ইয়াবা গডফাদার সাইফুল করিম, ছবি: সংগৃহীত ফাইল ফটো

কক্সবাজার: ‘দেশের শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার সাইফুল করিম প্রকাশ হাজি সাইফুল ইয়াবার ব্যবসা শুরু করেছিলেন ১৯৯৭ সালে। কিন্তু সে সময় ইয়াবার এতোটা পরিচিতি ছিল না। পরবর্তীতে প্রায় ১৫ বছর ধরে সাইফুল তার সীমান্ত বাণিজ্যেরে আড়ালে এই ব্যবসা চালিয়ে আসলেও তার বিরুদ্ধে টু-শব্দও হয়নি। ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকে বর্তমান ২০১৯ পর্যন্ত দফায় দফায় ক্ষমতার পালা বদল হলেও সাইফুলের ব্যবসার দাপট এক মুহূর্তের জন্যও কমেনি। কারণ তিনি বরাবরই থাকতেন ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে। বিএনপি আসলে তাদের, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ওদের। কৌশলে ইয়াবা সম্রাট সাইফুল ছিলেন একদম ধরাছোঁয়ার বাইরে।’

বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দিবাগত গভীর রাতে টেকনাফে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা ইয়াবার এ সম্রাটকে নিয়ে এমন তথ্য দেন।

কর্মকর্তা বলেন, বিগত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ইয়াবা নিয়ে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা শুরু হলেও ২০১৩ সালেই প্রথম পুলিশের তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী হিসেবে সাইফুলের নাম আসে।

তারপরও সাইফুলের বিরুদ্ধে কেউ টু-শব্দ করতো না। কারণ সাইফুল তৎকালীন সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আবার সাইফুলের ছিল বিশাল ক্ষমতার নেটওয়ার্ক। এমনকি তার কাছে নিয়ন্ত্রিত ছিলেন অনেক গণমাধ্যমকর্মীও। তাই সাধারণ মানুষতো নয়ই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও সাইফুল প্রসঙ্গে থাকতেন নীরব। এছাড়া আব্দুর রহমান বদির ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিতি থাকায় মাঝে মাঝে সাইফুলের ইয়াবার চালান আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও তিনি ঠিকই থাকতেন অধরা।

জানা গেছে, গত বছরের ৪ এপ্রিল চট্টগ্রামের হালিশহরে ১৩ লাখ ইয়াবার বড় একটি চালানসহ রশিদ ওরফে মুন্না ও আশরাফ আলী নামে দুই পাচারকারী পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন। এ সময় তারা দু’জনই চট্টগ্রামের আদালতে সাইফুল এবং মিয়ানমারের চোরাকারবারি আবদুর রহিমকে জড়িয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এরপর থেকে ব্যাপক আলোচনায় আসেন সাইফুল। এরপরও সীমান্ত এলাকার রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের কর্মকতা থেকে শুরু করে সবাই তাকে সমীহ করতেন। সর্বশেষ বছর দেড়েক আগেও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সাইফুলের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবুও অধরাই ছিলেন তিনি।

শুধু সীমান্ত এলাকায় নয়, পুলিশসহ দেশের বহু উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে তার দহরম মহরম সম্পর্কের কথা স্থানীয় এলাকায় প্রচার আছে। যদিও গত বছরের মে মাসে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে আত্মগোপনে চলে যান সাইফুল। সেই থেকে তাকে প্রকাশ্যে আর দেখা যায়নি। সম্প্রতি সপ্তাহ দেড়েক আগে কক্সবাজার আসেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফের এক আওয়ামী লীগ নেতা বাংলানিউজকে বলেন, সাইফুল এক সময় আব্দুর রহমান বদির সীমান্ত বাণিজ্য দেখাশোনা করতেন। এরপর ২০০৩ সালের দিকে গিয়েই শুরু করেন ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) ব্যবসা। এই ব্যবসার আড়ালে চলতো তার রমরমা ইয়াবা কারবার। সেখান থেকেই সাইফুল হয়ে উঠেন ইয়াবা সাম্রাজ্যের এক অধিপতি। রাতারাতি বনে যান কোটি কোটি টাকার মালিক। এর মধ্যে বিয়ে করেন টেকনাফের প্রভাবশালী বিএনপি নেতা আব্দুল্লাহর বোনকে। আবার সাইফুল নিজের বোনকে বিয়ে দেন টেকনাফের প্রভাবশালী সাংবাদিক নেতা ও জনপ্রতিনিধির কাছে। যে কারণে বলতে গেলে টেকনাফের প্রায় অনেক সাংবাদিকই সাইফুলের নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। সবমিলে দফায় দফায় সরকার পরিবর্তন হলেও সাইফুলের ক্ষমতায় কোনো সময়ই ভাটা পড়েনি।

ওই আওয়ামী লীগ নেতা আরও বলেন, কক্সবাজারের এক সময়ের ওসি (বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে কর্মরত) এবং পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সাইফুলের রয়েছে গভীর সম্পর্ক। যে কারণে পুলিশ কর্মকর্তারাও সাইফুলের বিরুদ্ধে কিছু করার সাহস করতেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে টেকনাফ থানায় কর্মরত ছিলেন পুলিশের এক কর্মকতা বাংলানিউজকে বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাদক ব্যবসায়ীর তালিকায় এক নম্বর এবং কক্সবাজারের গডফাদারের তালিকায় ২ নম্বরে সাইফুলের নাম। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সাইফুল এই ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসলেও পুলিশের তালিকায় তার নাম আসে ২০১৩ সালে। কেননা, তার এতোটাই প্রভাব ছিল, তালিকায় নাম আনাটাই পুলিশের জন্য অনেক দুরূহ ব্যাপার ছিল।

তিনি বলেন, শুধু প্রশাসনে নয়, টেকনাফের সাংবাদিকদের একটা বড় গ্রুপ সাইফুলকে দীর্ঘদিন ধরে সহযোগিতা করে আসছিল। তারা কৌশলে গণমাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসা আড়াল করে বড় একজন ব্যবসায়ী হিসেবে সাইফুলকে তুলে ধরে। এছাড়া সাইফুল এতোটাই প্রভাবশালী ছিলেন, টেকনাফের জাবেদ ইকবাল নামে এক সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায়, ওই নিরীহ সাংবাদিকের নাম তিনি ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত পৌর কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা একরামুল হককে পরিকল্পিতভাবে ইয়াবা কারবারী বানিয়েছিলেন এই সাইফুলই।

চট্টগ্রামে কাউন্টার টেররিজমের দায়িত্বে থাকা এবং তৎকালীন চট্টগ্রাম পুলিশের উপ কমিশনার শহীদুল্লাহ গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, সাইফুল ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম ইয়াবার চালান এনেছিলেন। দেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণীকে মাদকাসক্ত করার পেছনে তার ভূমিকা ছিল ব্যাপক। ১৩ লাখ ইয়াবা একসঙ্গে আটক হওয়ার পর তার সম্পর্কে আমরা এমন তথ্য পাই।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশকে মাদকমুক্ত করতে পুলিশের এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। মাদক ব্যবসায়ী যতোই শক্তিশালী হোক, কেউই পার পাবে না।

তিনি বলেন, আমরা মাদক ব্যবসায়ীদের জন্য দুটো পথ খোলা রেখেছি। হয় আত্মসমর্পণ করে সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে হবে, নয়তো শেষ পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

সাইফুল করিমের ইয়াবার রাজত্বের অবসান:
সপ্তাহ দেড়েক ধরে কক্সবাজারে গুঞ্জনের পর অবশেষে ৪৫ বছর বয়সী শীর্ষ ইয়াবা গডফাদার সাইফুল অধ্যায়ের অবসান ঘটেছে। সাইফুল বিদেশে আত্মগোপন অবস্থা থেকে দেশে ফিরে আত্মসমর্পণের জন্য পুলিশের হেফাজতে রয়েছেন এবং ঈদের পরেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবেন, এ রকম নানা গুঞ্জন শোনা গেলেও শেষপর্যন্ত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার পর সেই অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে।

পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাতে টেকনাফ স্থলবন্দর সংলগ্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সাইফুল নিহত হয়েছেন। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা, নয়টি দেশীয় তৈরি বন্দুক (এলজি), শটগানের ৪২টি তাজা কার্তুজ ও ৩৩টি কার্তুজের খোসা উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের দাবি, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ পুলিশের একজন উপ পরিদর্শক (এসআই) ও দু’জন কনস্টেবল আহত হয়েছেন।

নিহত সাইফুলের বাড়ি টেকনাফ পৌরসভার শীলবুনিয়া পাড়ায়। তার বিরুদ্ধে টেকনাফ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা রয়েছে।

এর আগে গত ৩ মে টেকনাফ থানার পুলিশ ১০ হাজার ইয়াবা, চারটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিজ বাড়ি থেকে সাইফুলের দুই ছোটভাই মাহবুবুল করিম ও রাশেদুল করিমকে গ্রেফতার করে। তারা বর্তমানে কক্সবাজার জেলা কারাগারে বন্দি।

গত বছরের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরুর পর থেকে র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও এলাকায় মাদকের প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় কক্সবাজার জেলায় এ পর্যন্ত ১০৬ জন নিহত হয়েছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০১৯
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।