ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দম ফেলার ফুরসত নেই ঈশ্বরদীর তাঁতপল্লির কারিগরদের

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০৬ ঘণ্টা, মে ২৬, ২০১৯
দম ফেলার ফুরসত নেই ঈশ্বরদীর তাঁতপল্লির কারিগরদের তাঁতপল্লিতে কাজ করছেন কারিগররা। ছবি: বাংলানিউজ

ঈশ্বরদী (পাবনা): বাঙালি রমণী এবং শাড়ি যেন এক মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আধুনিক যুগে এসেও রমণীদের দুর্বলতার জায়গায় রয়ে গেছে বাংলার শাড়ি। নারীদের আধুনিক পোশাকের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে এখনো মাথা উঁচু করে রয়েছে বাংলার আবহমান কালের ১২ হাতের শাড়ি। যদি সেটা হয় বেনারসি, কাতান, জামদানি তাহলে তো কথাই নেই। তাইতো সময় নেই কথা বলার কিংবা কারো দিকে তাকানোর। 

শাড়ি তৈরির ধুম লেগে গেছে। কারিগররা মহাব্যস্ত।

ঈদের আগেই ক্রেতাদের হাতে পছন্দের শাড়িটি তুলে দিতে নির্ঘুম রাত পার করছেন। ঈশ্বরদীর বেনারসি তাঁতপল্লির কারিগরদের দিন-রাত এখন সমান, দম ফেলার ফুরসত নেই তাদের।  

বুধবার (২২ মে) সকালে ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লিতে গিয়ে দেখা গেছে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছেন তারা, এখন যা আয় হবে এতে বছরের কয়েকমাস তাদের ভালোভাবে সংসার চলবে। ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির জামান ট্রেক্সটাইলে ১৭ জন বেনারসি কারিগর আপন মনে যত্ন করে বুনে চলেছেন এক একটি রং বেরঙের বেনারসি শাড়ি।  

ঈদকে সামনে রেখে ঈশ্বরদী তাঁতপল্লির কারিগররা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। দীর্ঘদিনের মন্দা কাটিয়ে তাঁতপল্লিতে ফিরে এসেছে প্রাণচাঞ্চল্য। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁত শ্রমিকেরা বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ী এবং রমণীরা আসেন শাড়ি কিনতে।  

এছাড়াও কলকাতাসহ অন্যান্য দেশে ঈশ্বরদীর বেনারসি শাড়ির ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রচুর অর্ডার আসছে। বাহারি রঙ ও সুক্ষ কাজের জন্য এবার ঈদে বিভিন্ন ধরনের কাতান শাড়ি গুরুত্ব পাচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের শাড়ির অর্ডার থাকায় সেগুলো তৈরিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে ফলে দিনরাত ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে কারিগরদের।  

তবে তাঁতপল্লির শ্রমিকরা জানান, বেনারসি পল্লিতে ক্যালেন্ডার মেশিন না থাকায় ঢাকার মিরপুর গিয়ে ক্যালেন্ডার পালিশ করতে হয়। আর এই পলিশ করতে প্রতি শাড়িতে অতিরিক্ত ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা খরচ গুনতে হয় তাদের। ঈশ্বরদীর তৈরি বেনারসি শাড়ি মিরপুরের শাড়ি বলে বিক্রি করে থাকেন ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটের শাড়ি ব্যবসায়ীরা। তাঁতপল্লিতে শাড়ি তৈরি করছেন এক কারিগর।  ছবি: বাংলানিউজ ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির জাবেদ ব্রাদার্স এর মালিক জাবেদ হোসেন (৫০) বাংলানিউজকে জানান, ঈশ্বরদীতে ইপিজেড, পাটকলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখন অনেকেই চাকরি করেন। তবে অন্য পেশায় চলে যাওয়া বেশ কিছু বেনারসি শ্রমিক আবার পল্লিতে ফিরে এসে কাজ করছেন বলে ঈদের আগে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।  এখন সময় বদলেছে, একজন বেনারসি শ্রমিক একটি শাড়ির কাজ করে সপ্তাহে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় করে থাকেন।       

বেনারসি কারিগর জাহাঙ্গীর আলম লিটন (৪৫) বাংলানিউজকে বলেন, দৈনিক ১০/১২ ঘণ্টা কাজ করে একটি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে কারিগর ভেদে ২/৩ দিন। শাড়ি প্রস্তুত হলে তা বেনারসি পল্লির শো-রুমে ওঠানো হয়। সেখানে প্রতিটি শাড়ি সর্বনিম্ন ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। আর কারিগর প্রতিটি শাড়ি প্রস্তুতের জন্য পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। সেই শাড়ি ২ হাজার থেকে শুরু করে ২৫ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়ে থাকে।   

বেনারসি কারিগর সোহেল রানা (৩০) বলেন, শাড়ি তৈরি করা ছাড়া আমরা আর কোনো কাজ পারি না বলেই দৈনিক ১২/১৪ ঘণ্টা কাজ করে সপ্তাহে দু’টি শাড়ি তৈরি করি। শাড়ি তৈরির পর পারিশ্রমিক ২ থেকে আড়াই হাজার। এইটুকু যদি না হতো পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে দিন কাটাতে হতো। বছরে দু’টি ঈদ ও পূজার সামনে শাড়ির চাহিদা বাড়ে। এসময় কাজ করে বেশি আয় করা সম্ভব হয়।  

জামান টেক্সটাইল এর নাসিম সরকার (৩৬) বাংলানিউজকে বলেন, কয়েক বছর আগেও ভারত-পাকিস্তান থেকে কাতান-বেনারসি চোরাই পথে বাংলাদেশে আনা হতো। এখন ঈশ্বরদীর তৈরি বেনারসি দেদারসে ভারত-পাকিস্তানে যাচ্ছে। আগের চেয়ে অনেকগুন বেশি উন্নতমানের শাড়ি এখন ঈশ্বরদীতে তৈরি হচ্ছে। উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঈশ্বরদীর তৈরি শাড়ি দেশের ব্যাপক চাহিদা মেটাটে পারবে।

ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির স্টেট অফিসার ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক বাংলানিউজকে জানান, ঈশ্বরদী শহরের ফতেহ মোহাম্মদপুরে অবস্হিত বেনারসি পল্লির নিয়মিত তাঁতীদের পাশাপাশি বিভিন্ন বাসা বাড়িতে প্রত্যেকেরই নিজস্ব তাঁত রয়েছে। এছাড়াও কয়েক হাজার শ্রমিক বিভিন্ন ধরনের শাড়িতে পুঁতি, ও কারচুপির কাজে ব্যস্ত। এবারের ঈদে তাদের শুধুমাত্র একটিই টার্গেট কাতান ও বেনারসি।  

তাঁতপল্লিতে শাড়ি তৈরি করছেন এক কারিগর।  ছবি: বাংলানিউজকেউ কেউ আবার বিন্দিয়া কাতান, পিওর বেনারসি শাড়িতে বিশেষ কারুকাজ, আনারকলি, ও ফুলকলি ছাড়াও নেট কাতান, পিওর কাতান, বেনারসি জুট জামদানি,  কুচি জামদানি,  মাসরাইস কাতান, ওপেরা কাতান, লেহেঙ্গা শাড়ি, ও বিভিন্ন মানের থ্রি-পিস তৈরি করছে।       

শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও ঈদের জন্য এখানকার শ্রমিকরা দিনরাত কাজ করছেন। তাদের নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন সব-সময় খোঁজ খবর রাখছেন আমরাও তাদের সুবিধা-অসুবিধার খোঁজ রাখছি।  

২০০৪ সালের ১২ ডিসেম্বর ঈশ্বরদী বেনারসি পল্লির উদ্বোধন করা হয় ৯০টি প্লট দিয়ে। উদ্বোধন এর পর ৮টি কারখানা চালু রয়েছে। অভিজ্ঞ শ্রমিকের অভাবে পল্লির বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যারা রয়েছে এখন তারাও দৈনিক ২০ থেকে ২৫টি উন্নত মানের শাড়ি তৈরি করে। শাড়ি তৈরির পর ঢাকার মিরপুর ও নারায়ণগঞ্জ এ পালিশ করার জন্য পাঠানো হয় এতেই কারখানা মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এখানকার কারিগর, কারখানার মালিক ও ব্যবসায়ীরা।      

ঈদের আগেই তাদের নিদিষ্ট টার্গেট পূরণ করার জন্য পল্লির বাইরে আরো প্রায় ৪শ’ বেনারসি কারখানায় ১ হাজার শ্রমিক দিন-রাত কাজ করছেন। ঈশ্বরদীর ফতেহ মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রত্যেকটি বাড়িতে বড়দের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের মেয়েরা কাজ করে চলেছে। কারোরই দম ফেলার ফুরসত নেই অথচ দীর্ঘ ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি পূর্ণাঙ্গ কারখানা।

ঈশ্বরদীতে বেনারসি শিল্পের ওপর নির্ভর করে এই এলাকায় কয়েকটি শাড়ির দোকান ও শো-রুম গড়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে অর্থের অভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে গেছে।

ভুক্তভোগীরা মনে করেন, সরকারিভাবে পল্লিতে বেসিক সেন্টার, ক্যালেন্ডার মেশিন স্হাপন ও কারখানা মালিকদের পর্যাপ্ত সুদমুক্ত ঋণ না দেওয়া হলে ঈশ্বরদীর তথা দেশের দ্বিতীয় বেনারসি পল্লিটি হয়তো অচিরেই হারিয়ে যাবে।  

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, মে ২৫, ২০১৮
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।