ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘তোরা অ্যার নুসরাতকে আনি দে’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৯
‘তোরা অ্যার নুসরাতকে আনি দে’ নুসরাতের মায়ের আহাজারি। ছবি: বাংলানিউজ

ফেনী: ‘তোরা আমার নুসরাতকে আনি দে, ও আমার বুকের মণি নুসরাত, ও আমার চোখের মণি রাফি, আমার শূন্য বুকে ফিরে আয়, ও আমার রাফি তুই কই, ও আল্লাহ আমাকে নিয়ে অ্যার (আমার) নুসরাত কে ফিরিয়ে দাও, চোখে ঘুম আইলেই (এলেই) অ্যার নুসরাতরে যন্ত্রণায় কাতরাইতে দেখি। অ্যাই (আমি) ঘুম যাইতান্ন, তোরা আঁর নুসরাতকে আনি দে (ফিরে দাও)’ ।

নুসরাতের শয়নকক্ষে তার খাটের উপর বসে এবং শুয়ে এভাবেই আহাজারি করছেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। তার আহাজারিতে কেঁপে উঠে সোনাগাজী পৌর শহরের উত্তর চর চান্দিয়া গ্রামের নুসরাতের বাড়ির চার পাশ।

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির গায়ে অগ্নিসংযোগের পর থেকে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) পর্যন্ত ১৭ দিনেও আহাজারি থামেনি নুসরাতের মমতাময়ী মা শিরিন আক্তারের।

নুসরাতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নুসরাত যে কক্ষটায় থাকতো সেখানো এখনো রাখা আছে তার পোশাক, বই-খাতা, আসবাবপত্র, সবই আছে, শুধু নেই নুসরাত। আর মেয়ের কক্ষে অবস্থান নিয়েছেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে এ কক্ষেই তিনি ঘুমাতেন। মায়ের বুকে ঘুমানোর সময় নুসরাত বলতেন নানা গল্প।

সেই খাটে শূন্য বুকে রাত্রি যাপন করছেন শিরিন আক্তার। কিছুতেই ঘুম আসে না তার। হাজারো স্বজন এসে তাকে সান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কেউ তার কান্না থামাতে পারছেন না। তার দাবি চোখে ঘুম এলেই যেন নুসরাত তাকে মা বলে ডেকে উঠে। তখনই তিনি নুসরাতকে খুঁজতে থাকেন। কিছুতেই ভুলতে পারছেন না নুসরাতের অতীত স্মৃতি আর পোড়া গায়ে দুঃসহ যন্ত্রণার কথা।

নুসরাতের পোড়া গন্ধে যেন আজও তার নাকে লাগছে। নুসরাতের স্মৃতি স্মরণ করে বুক থাবড়িয়ে থাবড়িয়ে আহাজারি করছেন শিরিন। আত্মীয় স্বজনেরা যেন তাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।

নুসরাত তার শয়ন কক্ষের দেওয়ালে লাল কাগজে লেখে রেখেছেন 'মা আমার চোখের মণি'। মায়ের উপর দুইটি কবিতাও লেখেছেন তিনি পাঠকদের পড়ার জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো ' আমি চাঁদকে বলি তুমি আমার মায়ের মতো সুন্দর নও, গোলাপকে বলি তুমি আমার ময়ের মতো মিষ্টি নও, মা যে আমার সবার সেরা বিধাতার শ্রেষ্ঠ উপহার, হয় না বন্ধু কারো সঙ্গে মায়ের তু্লো না। আই লাভ ইউ মা, আই মিস ইউ মা’ মাকে এমন করেই ভালোবাসতো প্রতিবাদী কন্যা নুসরাত জাহান রাফি। সে মেয়েকে হারিয়ে নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে আহাজারিতে কাটছে মায়ের দিন-রাত। কিছুতেই কোনো কথা বলেই সান্তনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বাবা-ভাইরাও নুসরাতের জন্য শোকে পাথর হয়ে আছেন।

গত ৬ এপ্রিল (শনিবার) সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় যায় নুসরাত। তখন তার সহপাঠী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে বলে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায় এক বোরকাপরিহিত ছাত্রী। সেখানে গেলে এই ছাত্রীকে মুখোশপরা ৪/-৫ জন অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তারা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চারদিন সর্বাত্মক চিকিৎসা চললেও সবাইকে কাঁদিয়ে ১০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যায় নুসরাত।

এদিকে এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল রাতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ ৮ জনের নামোল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

ওই মামলায় এখন পর্যন্ত এজহারভুক্ত ৮ জনসহ মোট ২০ জন গ্রেফতার হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ৮ জন। ১৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। এছাড়া শ্লীলতাহানির অভিযোগ করতে থানায় যাওয়ার পর নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়ায় ১৫ এপ্রিল সোনাগাজী থানার ওই সময়ের ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হয়েছে। এ মামলাও তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত।

হত্যা মামলায় কিলিং স্পটের যে পাঁচজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি (শম্পা) জানায়, নুসরাতকে হত্যা করার জন্য পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে সে-ই ছাদে ডেকে নিয়ে গেছে। তার নাম পপি হলেও হত্যাকাণ্ডের দিন হত্যাকারীরা তার পরিচয় গোপন রেখে ‘শম্পা' নামে ডাকে। সেজন্য নুসরাতও তাকে ডেকে নেওয়া বোরকাপরিহিত ছাত্রীটির নাম শম্পা বলে গিয়েছিল।

আর সিরাজ উদদৌলার ঘনিষ্ঠ নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম জানায়, জাবেদ ও পপি (শম্পা) সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয়। জাবেদ নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পপি ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এসময় তাদের সঙ্গে আরও তিনজন ছিলো।

শামীম তার জবানবন্দিতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর সে দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। বাইরে গিয়ে মোবাইল ফোনে বিষয়টি রুহুল আমিনকে জানায়। প্রত্যুত্তরে রুহুল আমিন বলেন, আমি জানি। তোমরা চলে যাও।

বাংলাদেশ সময়:  ০৭১৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১৯
এসএইচডি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।