ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বন্ড সুবিধার আড়ালে দেড়মাসে রাজস্ব ফাঁকি ৬৭ কোটি টাকা

গৌতম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৯
বন্ড সুবিধার আড়ালে দেড়মাসে রাজস্ব ফাঁকি ৬৭ কোটি টাকা

ঢাকা: রফতানিমুখী শিল্পের কথা বলে বন্ড সুবিধায় বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য দেদার খোলাবাজারে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে শুল্কফাঁকিতে আনা কাগজ জাতীয় পণ্যই বিক্রি হচ্ছে বেশি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্ড সুবিধায় এনে খোলাবাজারে এভাবে বিক্রির ফলে বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। গত দেড় মাসে এভাবে শুল্কফাঁকিতে পণ্য এনে ৬৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা রাজস্ববঞ্চিত করা হয়েছে সরকারকে। অন্য দিকে, বন্ড অপব্যবহারকারীদের দৌরাত্ম্যে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় কাগজ শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। 

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, বন্ড সুবিধার পণ্য কালোবাজারে বিক্রি এবং চোরাকারবারী ঠেকাতে গত মার্চ থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত ৪০টি প্রতিষ্ঠানে ঝটিকা অভিযান চালিয়েছে কমিশনারেটের ৮টি টিম। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০০ কোটি টাকার অনিয়ম পাওয়া গেছে।

পরে এ ঘটনায় ৩৬টি ফ্যাক্টরি, ৪টি ওয়্যার হাউসের ৪৭টি ট্রাক জব্দ করা হয়েছে। হিসাব মতে, এসব ট্রাকে আনা পণ্যে সরকার রাজস্ব হারায় প্রায় ৬৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা।  

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রফতানিমুখী শিল্পের কথা বলে এভাবে পণ্য আনলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার বাজার শুল্কমুক্ত সুবিধার পণ্যেই সয়লাব করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। পুরান ঢাকার ইসলামপুর, নয়াবাজার, চকবাজার মোড়েও খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য। আর বন্ডেড পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এ কারণে প্রত্যাশিত রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা।

জানা গেছে, শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যার হাউস সুবিধায় আমদানি হওয়া পণ্য চোরাই পথে কালোবাজারে বিক্রি প্রতিরোধে রাত-দিন বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছেন কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের একটি দলের সাহসী ও চৌকস কর্মকর্তারা। তবে অসাধু ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারীদের তৎপরতা কমাতে তাদের মোকামে অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হতে হয় ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারা।

কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের উপ-কমিশনার রেজভী আহম্মেদ ও সহকারী কমিশনার শরীফ মোহাম্মদ ফয়সালের নেতৃত্বে দু’টি প্রিভেন্টিভ দল গত ১৭ এপ্রিল রাতে পুরান ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালায়।

এ সময় নয়াবাজার মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি হওয়া কাগজ জাতীয় পণ্য ডুপ্লেক্স বোর্ডভর্তি তিনটি কাভার্ডভ্যান আটক করে দলটি। এসব পণ্য নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত ‘ভি টেক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের বন্ডেড প্রতিষ্ঠান চোরাই পথে খোলাবাজারে বিক্রির লক্ষ্যে নয়াবাজারে খালাস করছিল।  

ওসব চোরাই পণ্য আটক শেষে কাস্টমস কর্মকর্তারা ফিরে আসার সময় অবৈধ চোরাকারবারী চক্রের দুষ্কৃতকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিনা প্ররোচনায় ইটপাটকেল, লাঠিসোঁটা নিয়ে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। আহতদের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়।

কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর চোরাকারবারীদের এই ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রাণনাশের চেষ্টা এবং সরকারি সম্পদের ক্ষতিসাধনের অভিযোগে পরে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় একটি ফৌজদারি মামলা (২৭/১৪১) দায়ের করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের সহকারী কমিশনার আক্তার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গত দুই বছরে কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বন্ড সুবিধার অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।  

ওসব প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্যে বিদেশে অর্থপাচার করেছে। পণ্য এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে সরকারের বড় অংকের রাজস্বফাঁকি দিয়েছে। আর তাতে করে সৎ ব্যবসায়ীরা বিপদে পড়েছে।

তিনি বলেন, কাস্টমস কর্মকর্তাদের ওপর হামলাকারী প্রত্যেককে খুঁজে বের করবো। সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর আঘাতকারীদের আইনের আওতায় আনতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হামলাকারীরা সরকারি কাজে বাধা দিয়েছে। একইসঙ্গে সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে। তাদের কোনো ছাড় নেই।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের জিরো টলারেন্স নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। শত বাধা ও অনিরাপত্তার মধ্যে আমাদের কর্মকর্তারা অভিযান পরিচালনা করে থাকে। এজন্য তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কমিশনারের নেতৃত্বে সাতটি প্রিভেনটিভ টিম মাঠে কাজ করছে। রাতে অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পণ্য জব্দ করা হচ্ছে। পরে ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘দ্য কাস্টমস অ্যাক্ট ১৯৬৯, বন্ডেড ওয়্যার হাউস বিধিমালা ২০০৮’ এর আওতায় বিভাগীয় মামলা হয়। একইসঙ্গে তাদের বন্ডিং কার্যক্রম ও আমদানি-রফতানির তথ্য খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ফলে অসাধু ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কিছুটা কমে গেছে।  

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গ্রেড-১ এর মেম্বার সুলতান মো.ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে আমরা জিরোর টলারেন্স নীতিতে কাজ করছি। যারা বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করেছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে এ সুবিধাকে আধুনিকায়ন বা অটোমেশন করা হবে।  হামলা ও আটক পণ্যের বিপরীতে কাস্টমস আইনে মামলা দায়েরসহ বন্ডেড প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম খতিয়ে দেখবো।

দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের কাগজ এখন বিদেশে রফতানি হচ্ছে। মানও ভালো। পাশাপাশি চাহিদার চেয়েও বেশি উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে দেশি কাগজ কলগুলোর। তারপরও বন্ড সুবিধার আওতায় বিপুল পরিমাণ কাগজ আসছে বিদেশ থেকে। তাদের অভিযোগ, দেশে উৎপাদিত কাগজের মান-পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও আমদানি করা কাগজের মান যাচাই করা হচ্ছে না। ফলে মিথ্যা ঘোষণা আর শুল্কফাঁকি দিয়ে আনা নিম্নমানের বিদেশি কাগজ কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।  

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সরকার শতভাগ রফতানিমুখী শিল্পে পণ্য উৎপাদনে বন্ড সুবিধা নামে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত থাকে যে আমদানি করা কাঁচামালের পুরোটাই পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে কাঁচামাল হিসেবে বিনা শুল্কে আমদানি করা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করছেন। বন্ড সুবিধার আওতায় এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খুলে আমদানি করা পণ্যের মধ্যে আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কার্বনলেস পেপার ও হার্ড টিস্যু অন্যতম। তৈরি পোশাক ও এর সহযোগী শিল্পখাতের ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য সবচেয়ে বেশি আমদানি করে থাকেন।

জানা গেছে, দেশের প্রায় ৮৫টি কাগজ কারখানায় আর্ট কার্ড, ডুপ্লেক্স বোর্ড, কার্বনলেস পেপার, হার্ড টিস্যুসহ কাগজ জাতীয় বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। দেশীয় এই উৎপাদন স্থানীয় শিল্পের কাঁচামালের চাহিদা পূরণে পুরোপুরি সক্ষম। তারপরও শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীন, ভারত, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে কাগজ জাতীয় এসব পণ্য আমদানি করা হচ্ছে। তার ওপর বিনাশুল্কে আমদানি করা এসব পণ্য আইন ভেঙে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।  

এ অবস্থায় সব নিয়ম মেনে রাজস্ব দিয়ে পণ্য উৎপাদন করে বাজারজাত করতে গিয়ে অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে দেশি কাগজ শিল্পকারখানাগুলো। কারণ বিনাশুল্কে আমদানি করা পণ্য দেশে উৎপাদিত পণ্যের চেয়ে গড়ে টনপ্রতি ২০ হাজার টাকা কমে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়ত লোকসান গুনতে হচ্ছে স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

উল্লেখ্য, দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বন্ডেড ওয়্যার হাউসের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার। শুধু কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের আওতায়ই ৬ হাজার ৫৬৫টি বন্ডেড ওয়্যার হাউস রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চার হাজার ২৭২টি গার্মেন্টস বন্ড। অনিয়মের কারণে ১ হাজার ৭৫৭ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কাস্টমস। আবার কারখানা বন্ধ থাকার পরও বন্ড লাইসেন্স আছে ২৪৩৮টি পোশাক ও প্যাকেজিং কারখানার। এসব বন্ডেড ওয়্যার হাউসের কারখানায় পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল হিসেবে কাগজ-জাতীয় পণ্যের ব্যবহার হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৯
জিসিজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।