ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০১৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০১৯
কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই! ভিক্ষুকমুক্ত খুলনায় ভিক্ষুকের এমন আধিক্য দেখে লোকজনের প্রশ্ন-আসলেই কী খুলনা ভিক্ষুকমুক্ত

খুলনা: দুই বছর আগে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা করে খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু এখন ভিক্ষুকের আধিক্য আগের চেয়ে বেশি। আর্থিক অনুদান ও ব্যবসার উপকরণপ্রাপ্ত পুনর্বাসিত ভিক্ষুকরা নতুন করে ফিরেছেন পুরনো ‘পেশায়’। যার প্রমাণ পাওয়া যায় মহানগরীর খানজাহান আলী রোডের টুটপাড়া কবরস্থানের সামনে হাজার হাজার ভিক্ষুকের জটলা দেখলেই।

ভিক্ষুকমুক্ত খুলনায় ভিক্ষুকের এমন অবস্থান দেখে পথচারী অনেকেই বলছেন, এই হলো ভিক্ষুকমুক্ত খুলনার দৃশ্য। যেন ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’- অবস্থা।

রোববার (২১ এপ্রিল) পবিত্র শবে বরাত উপলক্ষে ভিক্ষুকরা জড়ো হয়েছেন মসজিদ-কবরস্থানের সামনে। খুলনার সবচেয়ে বড় টুটপাড়া কবরস্থানে স্বজনদের কবর জিয়ারত করে যাওয়ার সময় ভিক্ষুকদের দান করছেন লোকজন। তাদের সে দান পাওয়ার আশায় ভিক্ষুকদের এ জটলা। আর এ জটলার কারণে বিকেল থেকে খান জাহান আলী রোডের কবরস্থানের পাশের রাস্তায় যানজট লেগে আছে। গত বছর শবে বরাতে পুলিশ এখানে ভিক্ষুকদের বসতে দেয়নি। কিন্তু এবার আর বাধা দিচ্ছে না।

এখানে আসা ভিক্ষুকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় ভিক্ষুকদের সঙ্গে শবে বরাত উপলক্ষে যোগ হয়েছেন মৌসুমি ভিক্ষুক।  

ফিরোজা বেগম নামে এক ভিক্ষুক এসেছেন বরিশাল থেকে, এবারই তিনি এখানে এসেছেন বলে জানান। আর কারণ হিসেবে বলেন, গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার সন্তান মাথায় আঘাত পেয়েছে, চিকিৎসার জন্য টাকা যোগাড় করতে হবে।

খুলনা-তো ভিক্ষুকমুক্ত তবে কেন এসেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার বাচ্চারা বাসায় ভাতের জন্য কাঁদছে। আমি এখন কি করে ঘরে বসে থাকবো?

দর্শনা থেকে আসা শাহিদ জানান, প্রতি বছরই এখানে আসছেন। আপনাদের কি এখানে বসতে কেউ বাধা দিচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, না, তবে রাস্তায় বসতে দিচ্ছে না।

ভিক্ষুকমুক্ত খুলনায় ভিক্ষুকের এমন আধিক্য দেখে লোকজনের প্রশ্ন-আসলেই কী খুলনা ভিক্ষুকমুক্ত‘আল্লাহ দাও, খোদা দাও, বাবা দাও’ এমন কাকুতি মিনতি করে ভিক্ষা চাইছেন বকুল বেগম। তিনি খুলনা মহানগরীর ৪ নং ঘাট এলাকা থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, এখনও বেশি টাকা পাইনি। বিকেলে ১০০ টাকা পেয়েছি। রাতে বেশি টাকা পাবো।

ভিক্ষুকমুক্ত খুলনায় কেন ভিক্ষা করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার জামাই মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগে পাগল হয়ে গিয়েছিল। কিছু টাকা কড়ি রেখে যায়নি। আমি নিজেও অসুস্থ, কিভাবে চলবো?

রামপালের ফয়লা থেকে এসেছে হোসেন নামের ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী একটি শিশু। সঙ্গে আছে তার বাবা মা। সে জানায়, তার বাবা শারীরিক প্রতিবন্ধী, অন্যের সাহায্য ছাড়া নিজে চলতে পারে না। এখনো তেমন কোনো সাহায্য পায়নি। তবে রাত বাড়লে হতাশা কেটে যাবে।

রহিদুল গাজী নামের এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক জানান, প্রতিবছর এখানে ৪ থেকে ৫ হাজার ভিক্ষুক আসেন। তবে এবার দুই থেকে তিন হাজার এসেছে বলে তার ধারণা।

ভিক্ষুকমুক্ত খুলনায় কেন ভিক্ষা করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কি করবো ভাই আমার পা পঁচে গেছে। এক্সিডেন্ট করেছিলাম। কোনো কাজ করতে পারি না। তাই পেটের দায়ে এই পেশায় আছি।

তিনি জানান, তার বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি থানায়। তিনি রূপসা ঘাটে ভিক্ষা করেন। আজ বেশি সাহায্যের আশায় এখানে এসেছেন।

বিকেলে কবরস্থানের সামনের সড়কে ভিক্ষুকদের নিয়ন্ত্রণের কাজে থাকা খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) নিরাপত্তা কর্মীরা জানান, প্রায় দুই থেকে তিন হাজারের মতো ভিক্ষুক আসবে। এতে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই আগে থেকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করছি।

জানা যায়, ২০১৭ সালের ৮ মে খুলনা জেলাকে প্রাথমিকভাবে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করা হয়। মহতি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতনের অংশ তুলে দেন; সমাজের উচ্চবিত্তরা সহযোগিতা করেন। খুলনার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার মো. আব্দুস সামাদের এ মহৎ উদ্যোগের প্রশংসা উঠে আসে তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। ওই সময় মহানগরীসহ জেলার ৯টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৪৯৭ জন ভিক্ষুক শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৩ হাজার ৪৬৩ জন ভিক্ষুককে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য বিভিন্ন উপকরণ ও রেশনিংয়ের আওতায় পুনর্বাসিত করা হয়। ভিক্ষুকমুক্তকরণ, ভিক্ষুকদের কর্মসংস্থান ও পুর্নবাসনের আওতায় পুর্নবাসিতদের বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সাহায্য সহযোগিতাও করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পুরানো পেশায় ফিরে আসেন ভিক্ষুকরা।

অনেকে বলছেন, খুলনাকে ভিক্ষুকমুক্ত করা হলোও এখন ভিক্ষুকের আধিক্য আগের চেয়ে বেশি। প্রায় প্রতিদিনই নগরীর প্রতিটি এলাকায় ভিক্ষুকদের হরহামেশা দেখা যায়। ভিক্ষুকেরা হাত বাড়িয়ে দেন যত্রতত্র। আর শুক্রবার জুমার দিন বিভিন্ন মসজিদের সামনে ও গোরস্থানে ভিক্ষুকদের জটলা লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা খুলনা ইউনিটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বাংরানিউজকে বলেন, খুলনা জেলা প্রশাসনের ভিক্ষুকমুক্ত করার উদ্যোগ কাজে আসছে না। জেলা প্রশাসন খুলনা জেলাকে ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষণা করলেও গোটা নগরীতেই ভিক্ষুকদের আনাগোনা অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নজরদারি বৃদ্ধির দাবি করেন তারা।

এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত খুলনা জেলা প্রশাসক মো. ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আজকে একটি বিশেষ দিন। পবিত্র শবে বরাত উপলক্ষে সাধারণ মানুষের দান খয়রাতের আশায় ভিক্ষুকদের আনাগোনা বেড়েছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে আমরা মনিটরিং করছি। এ বছরও প্রায় ৭০ জনকে নতুন করে ভিক্ষা না করে ব্যবসা করার জন্য সাহায্য করেছি। ২০টি ভ্যানও দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ২০১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২১, ২০১৯
এমআরএম/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।