ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘পুড়িয়ে মারার আগে মানসিকভাবে মারা হয় নুসরাতকে’

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৯
‘পুড়িয়ে মারার আগে মানসিকভাবে মারা হয় নুসরাতকে’

ফেনী: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার আগে মানসিকভাবে মারা হয় দফায় দফায়। অপমান-অসম্মান এবং বিচার চাওয়ায় হেনস্তা করার পর ৬ এপ্রিল আগুনে পোড়ানো হয় তাকে। চার দিন যমের সঙ্গে লড়াই করে ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেলে কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বেডে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে সে। 

স্বজন, সহপাঠী ও পরিচিতজনদের অভিযোগ, আগুনে পুড়িয়ে মারার আগে নুসরাতকে দফায় দফায় মারার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা এবং মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন। নুসরাতের মায়ের দায়ের করা শ্লীলতাহানির মামলায় ২৭ মার্চই গ্রেফতার হন সিরাজ উদদৌলা।

৬ এপ্রিল আগুনে গুরুতর দগ্ধ হয়ে ১০ এপ্রিল নুসরাত মারা যাওয়ার পর থেকে আসামিদের গ্রেফতারের ধারাবাহিকতায় সবশেষ শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) আটক হন রুহুল আমিন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার হাতে শ্লীলতাহানির শিকার হওয়ার পর এ নিপীড়নের বিচার চাইতে গিয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয় নুসরাত, তার স্বজন ও সহপাঠীরা। সে সময় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজেম হোসেন কেবল নুসরাতই নয়, তার দুই বান্ধবীরও বক্তব্য আপত্তিকর কায়দায় ভিডিওধারণে বাধ্য করেন।  

স্বজনদের দাবি, তখনই পুলিশ এবং মাদ্রাসার কমিটি দোষীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে নুসরাতের এমন বিয়োগাত্মক ঘটনা এড়ানো যেতো।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নুসরাতের কয়েকজন সহপাঠী বাংলানিউজকে জানায়, ২৭ মার্চ সকালে নুসরাত ক্লাসে বসে তাদের সঙ্গে গল্প করছিল। এ সময় মাদ্রাসার পিয়ন নুরুল আমিন এসে অধ্যক্ষ ডাকছেন বলে নুসরাতকে জানান। নুসরাত তার দুই বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে যায়। অধ্যক্ষ সিরাজ বান্ধবীদের কক্ষের বাইরে বের করে দেন। বদ্ধ কক্ষ থেকে কয়েক মিনিট পর কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে বাড়ি চলে যায় নুসরাত। মেয়ের কাছ থেকে বিষয়টি জানার পর তার মা ছেলে রাশেদুল হাসান রায়হান ও স্থানীয় কাউন্সিলর ইয়াসিনকে নিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে যান। এ সময় অধ্যক্ষ সিরাজ উল্টো তাকে গালমন্দ করেন এবং নুসরাতের চরিত্রহননের অপচেষ্টা করেন। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে অধ্যক্ষ মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে ফোন করলে তিনি পুলিশ নিয়ে আসেন।  

সহপাঠীদের দাবি, অধ্যক্ষের সঙ্গে মিলে রুহুল আমিনও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন নুসরাত ও তার স্বজনদের। যদিও পরে নুসরাতের মা থানায় মামলা করলে অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

নুসরাতের সঙ্গে অধ্যক্ষের কক্ষে ঢুকতে চাওয়া একাধিক সহপাঠী বলেন, আমরা আগে থেকে জানি অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার চরিত্র খারাপ, তিনি মেয়েদের দিকে লোলুপ-দৃষ্টিতে তাকান। ২৭ তারিখের ঘটনার দিন আমরা নুসরাতের সঙ্গে গিয়েছিলাম। অধ্যক্ষ আমাদের তার কক্ষে ডুকতে দেননি। নুসরাত কক্ষের ভেতরে যায় এবং ১০ মিনিট ছিল। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর সে অফিস থেকে কাঁদতে কাঁদতে বের হয়ে আসে। কোনো কথা না বলেই বাড়ি চলে যায়।

নুসরাতে বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, অভিযোগ নিয়ে যাওয়ার পর সিরাজ উদদৌলা আমার মাকে গালিগালাজ করেছিলেন। সে সময় মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনও উপস্থিত ছিলেন। তিনি থাকাবস্থায় অধ্যক্ষ এমন আচরণ করছিলেন। তার নির্লিপ্ততা তখনো আমরা লক্ষ্য করেছিলাম।  

মাদ্রাসার ওই ঘটনার পর ২৭ মার্চ দুপুরে নুসরাত, তার মা ও দুই সহপাঠীকে থানায় ডেকে নিয়ে যান তখনকার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন (নুসরাতকে আগুনে পোড়ানোর পর প্রত্যাহার করা হয় তাকে)। এ সময় নুসরাত ও তার দুই সহপাঠী অস্বীকৃতি জানালেও নেকাব খুলে তাদের ভিডিওতে বক্তব্য ধারণে বাধ্য করেন ওসি। সেই ভিডিওতে কান্নারত নুসরাতের সঙ্গে ওসির অসহনশীল আচরণও স্পষ্ট হয়। এমনকি নুসরাত তার অভিযোগ বলার পর ওসি বলেন, ‘ব্যস এই টুকুই?’

এরপর সিরাজ উদদৌলার অনুগতরা প্রকাশ্যে মাদ্রাসার সামনে সোনাগাজী বাজারে তার মুক্তির জন্য মিছিল সমাবেশ ও মানববন্ধন করে। এসময় তারা নুসরাতের নামেও নানা আপত্তিজনক কথা বলে এবং সিরাজ উদদৌলাকে নির্দোষ দাবি করে।  

শ্লীলতাহানির বিচার চাইতে মাদ্রাসায় যাওয়ার পর মাকে গালিগালাজ, থানায় অভিযোগের ভিডিও ধারণের নামে আপত্তিকর কায়দায় হেনস্তা এবং সবশেষে তখনকার প্রশাসনের নাকের ডগায় সমাবেশ-মানববন্ধন করে তার চরিত্রহননের মাধ্যমে নুসরাতকে সেসময়ই মানসিকভাবে বারবার মারা হয়েছে বলে মনে করছে তার স্বজন-সহপাঠীরা।  

নুসরাতের ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান বলে, ‘২৭ মার্চের ঘটনার পর মাদ্রাসার ব্যবস্থাপনা কমিটি বিচারের দ্রুত পদক্ষেপ নিলে, আমার বোনের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না। তাৎক্ষণিভাবে যদি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তবে ঘটনা এতো মর্মান্তিক পরিণতিতে যেতো না। ’

গত ৬ এপ্রিল (শনিবার) সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় যায় নুসরাত। তখন তার সহপাঠী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে বলে নুসরাতকে ডেকে নিয়ে যায় এক বোরকাপরিহিত ছাত্রী। সেখানে গেলে এই ছাত্রীকে মুখোশপরা ৪/-৫ জন অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তারা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। তখন তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় চারদিন সর্বাত্মক চিকিৎসা চললেও সবাইকে কাঁদিয়ে ১০ এপ্রিল না ফেরার দেশে চলে যায় নুসরাত।

এদিকে এ ঘটনায় ৮ এপ্রিল রাতে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।

ওই মামলায় এখন পর্যন্ত এজহারভুক্ত ৮ জনসহ মোট ১৮ জন গ্রেফতার হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে পাঁচ জন। ১৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মাদ্রাসা কমিটির সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকেও আটক করা হয়েছে। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন।  

এছাড়া শ্লীলতাহানির অভিযোগ করতে থানায় যাওয়ার পর নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে ছড়িয়ে দেওয়ায় ১৫ এপ্রিল সোনাগাজী থানার ওই সময়ের ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে মামলা করা হয়েছে। এ মামলাও তদন্তের জন্য পিবিআইকে দায়িত্ব দিয়েছেন আদালত।

হত্যা মামলায় যে পাঁচজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে, তাদের মধ্যে উম্মে সুলতানা পপি (শম্পা) জানায়, নুসরাতকে হত্যা করার জন্য পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে সে-ই ছাদে ডেকে নিয়ে গেছে। তার নাম পপি হলেও হত্যাকাণ্ডের দিন হত্যাকারীরা তার পরিচয় গোপন রেখে ‘শম্পা' নামে ডাকে। সেজন্য নুসরাতও তাকে ডেকে নেওয়া বোরকাপরিহিত ছাত্রীটির নাম শম্পা বলে গিয়েছিল।

আর সিরাজ উদদৌলার ঘনিষ্ঠ নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম জানায়, জাবেদ ও পপি (শম্পা) সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয়। জাবেদ নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় আর পপি ওড়না দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে। এসময় তাদের সঙ্গে আরও তিনজন ছিলো।

শামীম তার জবানবন্দিতে জানায়, নুসরাতের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়ার পর সে দৌড়ে নিচে নেমে উত্তর দিকের প্রাচীর টপকে বের হয়ে যায়। বাইরে গিয়ে মোবাইল ফোনে বিষয়টি রুহুল আমিনকে জানায়। প্রত্যুত্তরে রুহুল আমিন বলেন, ‘আমি জানি। তোমরা চলে যাও। ’ 

বাংলাদেশ সময়: ১৭০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২০, ২০১৯
এসএইচডি/এইচএ/

** নুসরাত হত্যাকাণ্ড: অর্থের যোগানদাতাদের খুঁজছে সিআইডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।