ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রামুতে স্বর্গপুরী উৎসবে মিলনমেলা

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৯
রামুতে স্বর্গপুরী উৎসবে মিলনমেলা স্বর্গপুরী উৎসবে দর্শনার্থীর মিলনমেলা। ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: ‘স্বর্গ মানেই সুখ। এখানে দুঃখ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। ফুলের সমারোহে বসে অপ্সরীদের মেলা। কেউ গান গাইছে, আবার কেউ নাচছে। এই হলো স্বর্গের কল্পিত রূপ।

কিন্তু কোনো মানুষ চাইলেই বহু আকাঙ্খিত এ স্বর্গে পৌঁছাতে পারে না। সংসার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একমাত্র জীবদ্দশার ভালো কর্মের প্রভাবেই একপর্যায়ে মানুষ স্বর্গে আরোহণ করতে পারে।

আবার পুনঃজন্মগ্রহণ করে মর্ত্যলোকে ফিরে আসে। বলছিলাম কক্সবাজারের রামুর উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বন বিহারের ঐতিহ্যবাহী স্বর্গপুরি উৎসবের কথা।

মূলত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের স্বর্গ নিয়ে এ ধরনের ধারণা থেকেই দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে এখানে এ উৎসবের আয়োজন চলছে।

শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) বিকেলে প্রচণ্ড গরমের তীব্রতা উপেক্ষা করে হাজারো পূর্ণার্থী ও দর্শনার্থীর অংশ গ্রহণে মহামিলন মেলায় পরিণত হয় স্বর্গপুরী উৎসব, ব্যুহচক্র মেলা ও বৌদ্ধ মহাসন্মেলন।

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের রামু চা বাগান স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে গেলেই ছায়া সুনিবিড় উত্তর মিঠাছড়ি গ্রাম। গ্রামের পাহাড় চূড়ায়প্রজ্ঞামিত্র বন বিহারেই দীর্ঘ ৩৪ বছর ধরে আয়োজন হয়ে আসছে স্বর্গপুরী উৎসব।

সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা গেছে, বিহারের বিশাল মাঠজুড়ে তৈরি করা হয়েছে প্যাঁচঘর বা চক্রবাঁক।

এ প্যাঁচঘরের ঠিক মাঝখানে বাশঁ, কাঠ, কাগজ ও রঙের নানা কারুকাজে তৈরি করা হয়েছে দোতলা স্বর্গ। সেই স্বর্গে আরোহন এবং ব্যুহচক্র প্রদক্ষিণেই চলছে এক অন্য ধরনের আনন্দ যজ্ঞ।

বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা পূর্ণ্যার্থীরা সং সেজে  নানা বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে উল্লাস করতে করতে প্যাঁচ ঘরের আঁকাবাঁকা পথ ঘুরছে। এক ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে আরোহণ করছে সেই কাঙ্খিত স্বর্গে। দোতলা এ স্বর্গ থেকে নেমে আবার ঘুরতে ঘুরতে চলে আসছে বাইরে। এ সময় ঢোলের তালে তালে গাইছে বুদ্ধকীর্তন-‘স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এল,বুদ্ধ বল বলরে, বুদ্ধের মতো দয়াল আর নাই রে’। সে যেন এক অন্য ধরনের উৎসব।

উৎসবের উদযাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের বাংলানিউজকে জানান, শুক্রবার থেকে ৩৪ বছর আগে আমার শ্রদ্ধেয় গুরু ভান্তে প্রয়াত প্রজ্ঞামিত্র মহাথের এ উৎসবের সূচনা করেন। ২০০৭ সালে তিনি মারা যাওয়ার পরে আমরা এ উৎসবের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে আসছি।

তিনি আরও জানান, স্বর্গপুরী উৎসব এটি বর্তমানে সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ অংশে পরিণত হয়েছে। এই উৎসবের মাধ্যমে মানুষকে মূলত জীবদ্দশায় মানুষ যে কর্ম করে সেই কর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন কূলে তার জন্মান্তর ঘটতে পারে এমন ধারণা দেওয়া হয়।

বক্তব্য দেন সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলবিহারের দায়ক টিপুল বড়ুয়া জানান, চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের পরে স্বর্গপুরী উৎসবকে ঘিরে গ্রামবাসী আনন্দে মেতেছেন। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে সপ্তাহ-পাঁচদিন আগে থেকে গ্রামের বউ ঝিয়েরা নাইয়র আসেন। শিশু-কিশোর থেকে আবাল বৃদ্ধ বনিতার জন্য এ উৎসব এক ধরনের আনন্দ বয়ে আনে।

উৎসবে আসা দর্শনার্থী তুষিত বড়ুয়া বলেন, স্বর্গপুরী উৎসবে না এলে বোঝা যাবে না গ্রামের মানুষ এ উৎসবকে ঘিরে কি নির্মল আনন্দে মেতেছেন। যুগ যুগ ধরে এই জনপদের মানুষ এ উৎসব উদযাপন করে আসছে।

‘উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষনীয় দিক, সং সেজে নেচে-গেয়ে প্যাঁচঘর প্রদক্ষিণ করতে করতে স্বর্গে আরোহণ। আর কোনো কিছুর সহযোগিতা ছাড়া দুটি লম্বা বাঁশের উপর যুবকের হেঁটে হেঁটে প্যাঁচঘর প্রদক্ষিণ অবাক করা কাণ্ডই বটে’। এভাবেই অনুভূতি ব্যক্ত করলেন রামু প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক খালেদ শহীদ।

প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের অধ্যক্ষ সারমিত্র মহাথের বাংলানিউজকে জানান, তীব্র গরম উপেক্ষা করে এবারেও হাজার হাজার নারী পুরুষ উৎসবে অংশ নিয়েছে। শুধু রামু-কক্সবাজার নয়, জেলার বাইরে নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলী কদম, বান্দরবান থেকেও পূণ্যার্থীরা এবারে উৎসবে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া রামু উপজেলার প্রায় ১৫টি গ্রাম থেকে যুবকেরা দল বেধেঁ, সং সেজে উৎসবে যোগ দিয়েছে। স্থানীয় ভাষায় তাদেরকে বলা হয় ‘কান্ডবাজি’। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ প্রাণভরে এ উৎসব উপভোগ করেন।

অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলংকৃত করবেন বাংলাদেশি বৌদ্ধদের উপ-সংঘরাজ ও রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের।

প্রধান অতিথি ছিলেন কক্সবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল।  তিনি  বলেন, হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষ সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। দেশে কক্সবাজার-রামু সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মাঝেমধ্যে কিছু দুষ্কৃতকারী সম্প্রীতি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করে, তাদের চিহ্নিত করে সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে।

তিনি বলেন, কোনো অপশক্তিকে রামুর সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে দেয়া হবে না।  

দক্ষিণ চট্টলার বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বলেন, প্রায় শতবর্ষ আগে রামুর ঐতিহাসিক রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহারে ‘জগৎঠাকুর’ নামের এক বৌদ্ধ সংস্কারক এ উৎসবের আয়োজন করেন। উৎসব শুরু হতো বাংলা নববর্ষের শুরুতে। টানা সাতদিন। বর্তমানে এ মেলা রামকোটের মেলা নামে পরিচিত।

ধারণা করা হচ্ছে এ মেলা পরবর্তীতে স্বর্গপুরী উৎসবে রূপ নেয়। তবে বাংলাদেশে কবে কখন কিভাবে এ উৎসবের যাত্রা শুরু হয় তা সুষ্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি। বর্তমানে রাঙামাটি-কক্সবাজারে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।

শুক্রবার ভোরে প্রভাতফেরি সহকারে বুদ্ধ পূজা, সকালে অষ্টপরিষ্কারসহ মহাসংঘদান, মহতি ধর্মসভা, প্রয়াতপ্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র প্রতিবিম্ব উদ্বোধন ও উৎসর্গ, ভিক্ষু সংঘের পিন্ডদান, অতিথি ভোজন, দুপুরে স্বর্গপুরী উদ্বোধন, বিকেলে স্বর্গপুরী মেলা,ধর্মালোচনা সভা, সন্ধ্যায় স্বর্গপুরী উৎসর্গ ও প্রয়াত ধর্মগুরু প্রজ্ঞামিত্র মহাথের’র নির্বান সুখ কামনা ও বাংলাদেশসহ বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনাসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও রাতে অনুষ্ঠিত হবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৯
এসবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।