ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

স্বনির্ভর শিক্ষিত কৃষক রাজিয়া সুলতানা

সাগর ফরাজী, সাভার করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৯
স্বনির্ভর শিক্ষিত কৃষক রাজিয়া সুলতানা খামারে কাজ করছেন শিক্ষিত কৃষক রাজিয়া। ছবি: বাংলানিউজ

সাভার (ঢাকা): শিক্ষিত হলেই যে কেবল চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে হবে তা নয়। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টা থাকলে যে কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষাকে কাজে লাগানো যায়। আর নারী হয়ে জন্ম বলে ঘরে বসে শুধু হাঁড়ি-পাতিল ধুতে হবে, এমনটাও কখনো ভাবেননি স্নাতক পাস করা রাজিয়া সুলতানা। তিনি সবসময় ভেবেছেন কীভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। আর এ ভাবনা থেকেই টানা পাঁচ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে রাজিয়া আজ ‘স্বনির্ভর শিক্ষিত কৃষক!

২০১৪ সালে মাত্র ৪০০ হাঁস নিয়ে কৃষি খামার শুরু করেন রাজিয়া। সেসময় প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আসতো হাঁসের খামার থেকে।

একইসঙ্গে খামারের আশপাশের পতিত জমিতে নানা জাতের সবজির চাষাবাদ শুরু করেন তিনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে বেশ কয়েকবছর অক্লান্ত পরিশ্রমও করতে হয়েছে। পরিশ্রমের সুফল পাওয়ায় এখন সাভারের আউকপাড়ায় প্রায় ১৮ বিঘা জমি লিজ নিয়ে দেশি-বিদেশি নানা প্রকারের সবজি চাষ করছেন তিনি।

সম্প্রতি সাভারের আশুলিয়ার আউকপাড়া এলাকায় রাজিয়ার ওই খামার ও কৃষিজমি দেখতে গিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। জানা যায়, নারী হয়েও কীভাবে তিনি কৃষিকাজে সফল হয়েছেন।

নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে রাজিয়া সুলতানা জানান, ঢাকার সরদার সুরুজ্জামান মহিলা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেছেন তিনি। বাড়ি উত্তরায় বিমানবন্দরের কাছে। সেখান থেকে কৃষিকাজের সুবিধার জন্যই সাভারে আসেন রাজিয়া।

তিনি জানান, শিক্ষিত হওয়ায় কৃষি সংক্রান্ত সব কিছু খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছেন। আবার নারী হয়ে একাজ করতে গিয়ে অনেক কটু কথাও শুনতে হয়েছে তাকে। শহরের শিক্ষিত নারী হয়ে কৃষিকাজ করার বিষয়টা একসময় কেউ সহজভাবে নিতো না। অনেকেই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো আর বলতো, এ কাজে টিকে থাকা তো পরের কথা, বেশি দূর এগোতেও পারবেন না তিনি।

সুলতানা বলেন, অনেক নারী কৃষক আছে যারা পরিবারের দেখাশোনার পাশাপাশি কৃষিকাজ করছে। কিন্তু আমার বয়সী শিক্ষিত নারী খুব বেশি নেই। আগে এ কাজে প্রথমে অনেকেই সাহায্য করতে চাইতো না। বিশেষ করে পুরুষ শ্রমিক ও আশপাশের কৃষক যারা ছিলো তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো।

খামারে কাজ করছেন শিক্ষিত কৃষক রাজিয়া।  ছবি: বাংলানিউজ

সফলতার গল্প বলতে গিয়ে রাজিয়া বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে নানা জাতের বিদেশি সবজি চাষ সম্পর্কে ধারণা পেয়েছি। বীজ, সারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র অনলাইনে অর্ডার করে বিদেশ থেকে আনা হয়। দেশি সবজির পাশাপাশি চাইনিজ ক্যাপেজ, লেটুস, স্প্রিং অনিয়ন, ক্যাপসিকাম, লিভ ও চিরি টমেটো চাষ শুরু করি। এ বছর শিমলা মরিচ ও ক্যাপসিকাম চাষ হয়েছে বেশি। এদের উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি হলেও বাজারে চাহিদা প্রচুর। চীনের এ ক্যাপসিকাম একবার রোপন করলে ৫-৬ মাস ফলন পাওয়া যায়। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৭০০-৮০০ কেজি ক্যাপসিকাম উৎপাদন হয়, যার প্রতিকেজির দাম ৭০-৮০ টাকা।  

রাজিয়া বলেন, বছরে ছয়মাস সবজি চাষ করি। আর বাকি সময় গরু-ছাগল পালন করি। প্রতি মৌসুমে প্রায় সাত থেকে আট লাখ টাকার সবজি উৎপাদন হয় আমার খামারে।

নিজের কাজ সম্পর্কে কর্মঠ এ নারী বলেন, চারা উৎপাদনের কাজ নিজ হাতেই করি। কখন সার দিতে হবে, পানি দিতে হবে, কোন সময় কোন কীটনাশক দিতে হবে এসব নিজেই দেখাশোনা করি। কারণ আমি কাজ না করলে তো আমার লোকজনও ঠিকমতো কাজ করবে না।  

পেশা হিসেবে কৃষিকাজ কেন বেছে নিলেন? -এমন প্রশ্নের জবাবে রাজিয়া বলেন, এ কাজ করে আমি আমার পরিবারকেও ভালো সময় দিতে পারি। দেখা গেছে, আমার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি দুই-চারদিন বাসায় থাকতে পারছি। কিন্তু যদি চাকরি করতাম তখন এ সুযোগটি ছিলো না। হয়তো আমাকে চাকরি ছাড়তে হতো, নয়তো অফিসে যেতে হতো।  

একাজে স্বামীর সর্মথন আছে কি না?- এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে আমি আমার স্বামীর পুরোপুরি সমর্থন পাওয়াতেই এ জায়গায় আসতে পেরেছি। চাষাবাদের ব্যাপারে আমার চেয়ে স্বামীর আগ্রহই বেশি। আমাদের চাষাবাদের বীজগুলো মূলত দেশের বাইরে থেকে আনা হয়। আর এসব অর্ডার করতে হয় অনলাইনে। তথ্যপ্রযুক্তির কাজটা আমার স্বামীই করেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রাজিয়া বলেন, সম্প্রতি হেমায়েতপুরের ধল্লা এলাকায় একটি জমি দেখে এসেছি। আগামী দুই মাসের মধ্যে সেখানে কাজ শুরু করবো। ওই জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করবো। উপজেলা কৃষি অধিদফতর থেকে সবসময় আমাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এ এলাকার মাঠকর্মী নিয়মিত আসেন ও আমাদের বিভিন্ন ট্রেনিং দেন। সবাই আমাদের সাহায্য করছে।

নতুন যারা কৃষিকাজে আগ্রহী তাদের উদ্দেশে সফল এই নারী কৃষক বলেন, নতুন যারা কৃষিকাজ করতে চান তারা অবশ্যই জেনে-বুঝে বাজার দেখে ও কোথায় থেকে কীভাবে শুরু করতে হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসবেন।

রাজিয়া আরও বলেন, আমাদের দেশে অনেক মডেল কৃষক আছে। সরকার যদি একটু সহায়তা করতো তাহলে আর বিদেশের দিকে তাকাতে হতো না। দেশের টাকা দেশেই থাকতো।

বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৯/ আপডেট: ১৪৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৯, ২০১৯
একে/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।